দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর হোজা নদী

রাজশাহীর দুর্গাপুর পৌরসভার সিংগা বাজার এলাকায় হোজা নদীর একটি অংশ ময়লা–আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছেছবি: প্রথম আলো

একসময় নদীটি দিয়ে নৌকা চলাচল করত। ছিল প্রবল স্রোত। নদীতে ধরা পড়ত প্রচুর মাছ। নদীর সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এসব শুধুই অতীত। ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। দখল-দূষণে হুমকির মুখে পড়েছে নদীটির অস্তিত্ব।

মৃতপ্রায় এই নদীর নাম হোজা। এটি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে পড়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটারেই পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। অনেক স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। আবার কোথাও কোথাও পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে।

নদী ভরাটে পিছিয়ে নেই দুর্গাপুর পৌরসভাও। পৌরসভার সিংগাবাজার অংশের সেতুর দুই পাশে পৌর এলাকার সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে ওই সেতুর দুই পাশের ২০ শতাংশ জমি ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া বর্জ্যের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় ওই অংশ দিয়ে নাক চেপে চলাচল করতে হয় পৌরসভার বাসিন্দাদের।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ কার্যালয়ের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলার নিয়ম নেই। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ নদীতে বর্জ্য ফেলছে।

এ বিষয়ে দুর্গাপুর পৌরসভা মেয়র সাজেদুর রহমান বলেন, পৌরসভার আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তাঁরা ইতিমধ্যে পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিকল্পনা করছেন। তাঁরা বর্জ্য ফেলার জন্য জমিও খুঁজছেন।

১০-১২ বছর বয়সে এই নদীতে নামতে ভয় হতো। যুবক বয়সেও নামা হয়নি ভয়ে। আশির দশকে প্রথম শুকিয়ে যেতে থাকে।
আরিফুল ইসলাম, সিংগা বাজার, দুর্গাপুর

দুর্গাপুর উপজেলা সদরে নদীর পাশেই বাড়ি শ্রীবাসীর (৭২)। হোজা নদীর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, দুর্গাপুর উপজেলা থেকে তিনি দাদুর বাড়ি বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরে যেতেন হোজা নদী দিয়ে। তখন এই নদীতে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। তিনি বলেন, ময়লা-আবর্জনা ফেলে ফেলে নদীটাকে তো মেরে ফেলা হচ্ছে। নদীটার খনন দরকার।

পদ্মার একটি প্রশাখা নদী হলো হোজা। এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার। ‘গঙ্গা-পদ্মা-পদ্মাবতী’ শিরোনামে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর বইতে এই নদী সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে হোজা নদী গঙ্গার প্রশাখা। রাইচান ও দয়া নদীর মিলিত ধারাটি রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার ফলিয়ার বিলে পতিত হয়েছে। সেখান থেকে হোজা নামের নদীটি উৎপন্ন হয়ে দুর্গাপুর উপজেলা হয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে গিয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে পড়েছে। মুসাখান আবার বড়ালে গিয়ে পড়েছে। বড়াল গঙ্গার অন্যতম শাখা নদ।

‘গঙ্গা-পদ্মা-পদ্মাবতী’ বই ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নদীর উৎসমুখ দুর্গাপুরের পলাশবাড়ী থেকে তিন কিলোমিটারের বেশি এলাকায় ১০-১২টি পুকুর কেটে দখল করে ফেলা হয়েছে। তবে দুর্গাপুরের আমগ্রাম থেকে দমদমা বিল পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার পানির প্রবাহ আছে। এরপর আবার দমদমা থেকে পুঠিয়া উপেজলা কাঁঠালবাড়ি পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে।

হোজা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আরিফুল ইসলাম নামে একজনের সঙ্গে কথা হয়। নদীর ধারে তাঁর জুতা বিক্রির দোকান আছে। তিনি জানান, পৌরসভার যত ধরনের বর্জ্য আছে, সব এই নদীতে ফেলা হয়। নদীর দিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ প্রস্রাব করেন। দুর্গন্ধে থাকা যায় না। এখানে আবর্জনা ফেলতে মানা করলেও কেউ শোনেন না। আবর্জনা ফেলতে ফেলতে নদীটা এখানে প্রস্থে ছোট হয়ে গেছে।

পৌরসভা ধরে আরেকটু পূর্বদিকে এগিয়ে গিয়ে মো. সান্টু আলী (৬৭) নামের একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাঁশ ব্যবসায়ী। দুজন শ্রমিক দিয়ে হোজা নদীতে বাঁশ ডুবিয়ে রাখছিলেন তিনি। তিনি জানান, ‘নদীর পারেই আমার জন্ম হয়েছে। ১০-১২ বছর বয়সে এই নদীতে নামতে ভয় হতো। যুবক বয়সেও নামা হয়নি ভয়ে। আশির দশকে প্রথম শুকিয়ে যেতে থাকে। নদীর সঙ্গে অনেকগুলো খাল আছে। সেখানে পুকুর হয়ে নদীর মুখগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

পৌরসভার সিংগা বাজারে নদীর উত্তরপাশে দুইতলা ভবন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসানুজ্জামান টুটুল। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, তিনি নদীর একটি অংশ দখল করে ভবন করেছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে হাসানুজ্জামান বলেন, নদী দখল করে নয়, নিজের জমিতে ভবন করেছেন তিনি। এর ঠিক পূর্বপাশে স্থানীয় ইসরাফিল হোসেন নদীর একটি অংশ দখল করে টিনশেডের একটি গুদামঘর নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে চাইলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

দুর্গাপুর পৌরসভার পূর্বদিকে হরিপুর গ্রামে হোজা নদীর একটি ধারা ডারবিন বিলের দিকে গেছে। সেই ধারায় পাঁচ বছর আগে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করেছেন স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি। এর ফলে ওই অংশ দিয়ে নদীতে পানি নামতে পারে না। ওই অংশে বাঁধ দিয়ে যে কয়জন মাছ চাষ করছেন, তাঁদের মধ্যে আসলাম আলী নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তিনি মুঠোফোনে নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কথা স্বীকার করে বলেন, এই অংশ দিয়ে ডারবিন বিলে একসময় নৌকা চলাচল করত। এখন নদী মরে গেছে। তার ঠিক উত্তরপাশে ওই বিলে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন মোকশেদ আলী নামের আরেকজন।

বেলার রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ কার্যালয়ের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, নদীর পানি কোনোভাবেই দূষিত করা যাবে না এবং নদী দখল করা যাবে না।