স্বপ্নের পেছনে ছোটা স্বপ্নীল কুমিল্লার প্রথম নারী বাইক ও স্কুটি প্রশিক্ষক
কয়েক বছর আগেও কুমিল্লা নগরের সড়কে কোনো নারী মোটরসাইকেল বা স্কুটি চালিয়ে চলাচল করছেন—এমন দৃশ্য চোখে পড়ত না। এখন নগরের সড়কে প্রায়ই নারীদের মোটরসাইকেল বা স্কুটি চালাতে দেখা যায়। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন স্বপ্নীল সুলতানা নামের এক নারী।
কুমিল্লার মুরাদনগরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে স্বপ্নীল। কুমিল্লা নগরে তিনিই প্রথম নারীদের বাইক ও স্কুটি চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। গত সাত বছরে তিনি আড়াই হাজারের বেশি নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এরই মধ্যে নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে চালু করেছেন স্কুটি ও বাইক প্রশিক্ষণ সেন্টার। যেখানে তাঁর সঙ্গে নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আরও পাঁচ তরুণী।
স্বপ্নীল সুলতানা কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেন। ২০১৭ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর চাকরি হয়। স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান বলে সেই চাকরি দুই বছরের মাথায় ছেড়ে দেন। তাঁর স্বামী প্রাণিসম্পদ বিভাগে চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার।
শুরুর কথা জানতে চাইলে স্বপ্নীল সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে স্কুলে পড়ার সময় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে বাইক চালানো শিখেছিলেন। ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেন। পরের বছর একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তবে স্বামীর উৎসাহে পড়াশোনা চালিয়ে যান। বিয়ের পর মাঝেমধ্যে স্বামীর মোটরসাইকেল চালাতেন। নিজের একটা মোটরসাইকেলের স্বপ্ন ছিল তাঁর। পরিবারের কেউ অবশ্য এটা সমর্থন করেননি। ২০১৭ সালে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে জমানো কিছু টাকা এবং বাকিটা কিস্তিতে নিয়ে তিনি একটি স্কুটি কেনেন। ওই বছরই তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান। স্কুটিতে করেই বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন তিনি। তখন কেউ কেউ কটুকথা বলতেন, কেউ আড়চোখে দেখতেন, অনেকেই উৎসাহ দিতেন। নারীরা জানতে চাইতেন, তিনি কোথায় স্কুটি চালানো শিখেছেন, তাঁরাও শিখতে চান। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নারীদের মোটরসাইকেল ও স্কুটি চালানো শেখাবেন।
স্বপ্নীল সুলতানা বলতে থাকেন, ২০১৮ সাল থেকে তিনি নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। প্রথমে মাত্র তিনজনকে দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর তিনি ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে প্রচার চালান। আস্তে আস্তে আগ্রহী নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে করোনার কারণে কয়েক মাস শেখানোর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তাঁর ভাষ্য, এখন পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি নারী তাঁর এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০০ জন নিয়মিত স্কুটি চালাচ্ছেন। কুমিল্লা নগর ও আশপাশে নিয়মিত স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালান—এমন নারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০।
কুমিল্লায় তিনিই প্রথম নারীদের স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন উল্লেখ করে স্বপ্নীল সুলতানা বলেন, ‘আমার প্রশিক্ষণ সেন্টারে এখন পাঁচজন মেয়ে কাজ করছে। তারা আমার কাছেই শিখেছে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৫টি স্কুটি ও একটি বাইক আছে। এখন নারীরা শখে নয়, প্রয়োজনেই স্কুটি চালানো শিখছেন। একজন নারী সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে বাজার করার কাজটাও করছেন স্কুটি চালিয়ে। কয়েক দিন আগে এক নারী আমাকে বললেন, আগে যাতায়াতে মাসে ১২ হাজার টাকা খরচ হতো, এখন সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকার তেল খরচ হয়।’
আমি স্কুটি চালানো শিখে এখন বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে সব কাজ করি। এতে জীবনযাত্রা অনেক সহজ ও নিরাপদ হয়েছে।
বর্তমানে প্রতি মাসেই কমপক্ষে ৩০ জনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন জানিয়ে স্বপ্নীল সুলতানা বলেন, গৃহিণী থেকে শুরু করে কলেজের মেয়েরা শিখতে আসেন। জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে নেন তিনি। শুধু কুমিল্লা শহর নয়, আশপাশের জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা থেকেও নারীরা শিখতে আসেন।
স্বপ্নীল সুলতানার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নিজেই অন্যদের শেখাচ্ছেন বলে জানালেন সুমাইয়া সুলতানা নামের এক তরুণী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপ্নীল আপুর সঙ্গে নারীদের স্কুটি শিখিয়ে মাসে ভালো আয় করছি। ভালো লাগছে নারীদের পথচলা সহজ হচ্ছে দেখে।’
কুমিল্লা নগরের কাপ্তানবাজার এলাকার বাসিন্দা ফারিহা ইসলাম বলেন, ‘আমি স্কুটি চালানো শিখে এখন বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে সব কাজ করি। এতে জীবনযাত্রা অনেক সহজ ও নিরাপদ হয়েছে। নিজের বাইকে করে চলাচল করছি। অন্য যানবাহনে পুরুষদের সঙ্গে বসতে হচ্ছে না।’
কুমিল্লার বিশিষ্ট নারীনেত্রী দিলনাশি মোহসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে স্বপ্নীল খুব ভালো কাজ করছেন। তাঁর এমন উদ্যোগের কারণে কুমিল্লা নগরে এখন অনেক নারীকে বাইক ও স্কুটি চালাতে দেখা যায়। এটা মেয়েদের পথচলাকে সহজ করে দিয়েছে।