‘আহারে হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাইয়ের হাত!’

রাজশাহীতে বাতিঘর আয়োজিত 'আমার জীবন আমার রচনা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে গতকাল শুক্রবার তরুণ পাঠকদের উদ্দেশে কথা বলেন জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ছবি: প্রথম আলো

আমি তখন সদ্য দেশে এসেছি। একদিন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হাঁটছি। একজন লোক এসে বললেন, ‘আপনি দেশে এসেছেন শুনে অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। আজ আপনাকে পেয়েছি। আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?’ আমি খুশি হলাম। একজন মানুষ আমার হাত ধরতে চাচ্ছেন। লোকটা এবার আমার হাতটা বুকে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘আহারে হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাইয়ের হাত!’ আমিও খুশি হলাম। আমি তো হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাই।

শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহীতে বই বিক্রি ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘর আয়োজিত ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তরুণ পাঠকদের সামনে জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর প্রয়াত ভাই জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার উদাহরণ দিতে গিয়ে গল্পটি শোনান। বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ এত জনপ্রিয় লেখক হওয়ার কারণ হচ্ছে, তিনি প্রচুর বই পড়তেন। জন্মের পর থেকে শুধু পড়তেন আর পড়তেন। না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না যে একজন মানুষ এক জীবনে এত বই পড়তে পারেন!’ এই কথার সূত্র ধরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তরুণ পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, ‘বই পড়ার বিষয়টি আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। আজ যারা বই পড়ছে, তারাই আগামী দিনের পৃথিবীর নেতৃত্ব দেবে। যারা বই পড়ে না, তারা পৃথিবী চালাবে না।’

অনুষ্ঠানের শুরুতেই জনপ্রিয় এই লেখক বিনয় প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্যানারে আজকের অনুষ্ঠানের যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, সেটি আমার দেওয়া নয়। বাতিঘর কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। আমি মনে করি না যে এই শিরোনাম দেওয়া ঠিক হয়েছে। কারণ, আমার জীবন এমন কিছু না যে আমি সবাইকে বলব, ভাই আসুন আমার জীবনটা শুনুন। আবার আমার রচনাও এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না যে বলব আমার রচনার কথা শুনুন। তবে এখানে এসে ভালো লাগছে যে তোমরা যারা এখানে এসেছ, তারা নিশ্চয়ই বই পড়তে ভালোবাসো। তোমাদের অভিনন্দন জানাই।’

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বই মানুষকে কল্পনা করার ক্ষমতা দেয়। মানুষের এই কল্পনা করার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘যারা লেখক হতে চাও, তাদের আমি একটা সহজ উপায় বলে দিই। লেখক হতে চাইলে প্রচুর বই পড়তে হবে। পড়তে পড়তে বই লেখার একটি ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। কেউ যদি বই লিখে নিজের টাকা দিয়ে প্রকাশ করে, তাহলে তাকে লেখক বলা যাবে না। এই বই বন্ধুবান্ধবদের দিলে তারা নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখবে। কেউ পড়বে না। আগে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে লেখা পাঠাতে হবে। পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। তারপর  যদি কোনো প্রকাশক নিজের টাকায় বইটা ছাপতে চান, তখন বলা যাবে লেখক।’

এরপর তরুণ পাঠকদের কাছ থেকে প্রশ্ন চাওয়া হয়। একজন প্রশ্ন করেন, ‘স্যার, আপনার এই সুন্দর গোঁফের রহস্য কী?’ এর উত্তরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমার আগে গোঁফ ছিল না। আমি যখন পিএইচডি করতে যাই, তখন সেখানে আমি ও আমার স্ত্রী ইয়াসমিন, শুধু দুজন বাংলাদেশি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে থাকলে যা হয়! আমরা বিয়ে করতে চাই। ইয়াসমিন বলল, “তোমাকে এত বাচ্চা–বাচ্চা দেখায়! আমার বাবা কিছুতেই তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।” তখন চিন্তা করতে লাগলাম কীভাবে চেহারায় একটু বয়সের ছাপ আনা যায়। একজন আইডিয়া দিলেন, তুমি গোঁফ রেখে দাও তাহলে তোমাকে একটু বয়সী মনে হবে। সেই গোঁফ রেখে দিলাম। ইয়াসমিনের বাবা রাজি হলেন। আমাদের বিয়ে হলো।’

একজন প্রশ্ন করলেন, রাজশাহীর এই গরমে তাঁর কেমন লাগছে? উত্তরে জনপ্রিয় এই লেখক বলেন, ‘আমাকে গরমের ভয় দেখাচ্ছ? আমার কিন্তু গরমের কোনো ভয় নাই। আমার বাড়িতে কোনো এসি নাই। আমি এসি ব্যবহার করি না। সুতরাং গরমে আমার কিচ্ছু আসে যায় না।’ আরেকজন বলেন, আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় নন। তখন মুহম্মদ জাফর ইকবাল পকেট থেকে ছোট্ট একটা বাটন ফোন বের করে বলেন, ‘এইটা দিয়ে কি ফেসবুক চালানো যায়?’

পাঠকদের নানা প্রশ্নের উত্তরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তাঁর বাবার লাশ উদ্ধারের মর্মান্তিক কাহিনি, তাঁদের একটি পোষা হরিণ মুক্তিযুদ্ধের পর কীভাবে উদ্ধার হয়েছিল—এসব নিয়ে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, তাঁর বাবাকে গুলি করার সময় বাবা হাত তুলে বলেছিলেন, ‘হে খোদা, তোমাকে তো এত দিন বলতে পারি নাই। তুমি আমার সন্তানগুলোকে দেখো।’ সত্যিই তিনি আমাদের দেখেছেন। আমরা মানুষ হয়েছি।