দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির যাতে প্রতিবাদ না হয় সে জন্য বন্দরে সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা: আনু মুহাম্মদ
অর্থনীতিবিদ ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘বন্দর এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। বলা হয়েছে, যানজটের কারণে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। তার মানে ১১ নভেম্বরের পর থেকে যানজট যদি হয়, আমদানি-রপ্তানির সমস্যা হবে না। এই এক মাসই শুধু সমস্যা। এর মানে এই এক মাস যেন কোনো প্রতিবাদ না হয়। এর অর্থ, তাঁদের ইচ্ছা আগামী ১১ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ও বিপজ্জনক একটি চুক্তিতে যাওয়া।’
আজ শনিবার বিকেলে চট্টগ্রামে ‘জাতীয় সক্ষমতা ও জাতীয় নিরাপত্তা: চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গ’ শিরোনামে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে এ কথাগুলো বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং টার্মিনালকে বিনা টেন্ডারে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া দেশের জন্য নিরাপত্তাঝুঁকি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকায় জিয়া স্মৃতি জাদুঘর সেমিনার হলে এ সভার আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন। এতে মূল দাবি ছিল, জাতীয় সমুদ্রবন্দর জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। উপস্থিত বক্তারা চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে ঝুঁকি ও বন্দরের বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের নির্দেশ নিশ্চয় ওপর থেকে এসেছে। আমরা আগেও এমন নির্দেশ দেখেছি। আমাদের দাবি হচ্ছে, অবশ্যই এই তৎপরতা বন্ধ করবেন। বাম, ডান, মধ্যপন্থী সব রাজনৈতিক দলকে বলব, বিশেষত যাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য চাইছেন; এই ধরনের তৎপরতা বন্ধ করতে আপনাদের ভূমিকা নিতে হবে। না হয় দায় আপনাদের ওপরও পড়বে।’
উপদেষ্টারা তাড়াহুড়া করছেন—এমন মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার হলে সেটা করবেন সামনে নির্বাচিত সরকার। আপনাদের এত তাড়াহুড়া কিসের?’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘কোথাও কি মুচলেকা দেওয়া আছে; যে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিতেই হবে?’ তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত একটি জাতীয় সম্পদ কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে দেওয়া চলবে না।
বন্দরের অন্যান্য সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি করতে সময় লাগে। কাস্টমসের জন্য, আমলাতন্ত্রের জন্য দেরি হয়। কাস্টমস একই থাকবে, আমলাতন্ত্র একই থাকবে, যোগাযোগব্যবস্থা একই থাকবে—অথচ যে অপারেটর লাভজনকভাবে পরিচালনা করছেন, তাঁদের বদলালে সক্ষমতা বাড়বে, এটা কী ধরনের যুক্তি? অন্যান্য শর্তগুলো তো পরিবর্তন হলো না। যুক্তিগুলোর মধ্যে সংগতি নেই, সরকার জবাবদিহির মধ্যে নেই।’
গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন চট্টগ্রামের সংগঠক আসমা আক্তারের সঞ্চালনায় এতে আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর সিবিএর সাবেক সেক্রেটারি শ্রমিকনেতা শেখ নূরুল্লাহ বাহার, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য ফেরদৌসি রুমি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
শ্রমিকনেতা শেখ নূরুল্লাহ বাহার বলেন, বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দিলে দেশের নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়বে। বর্তমানে যাঁরা উপদেষ্টা আছেন, তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে বিদেশি কোম্পানিকে দিতে। লালদিয়ার চরের সংবেদনশীল এলাকাও বিদেশিদের দেওয়া হচ্ছে। বে টার্মিনালেও একটি প্লট ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, অতীতে বিভিন্ন দেশে বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বর্তমানে বন্দর নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে লাভজনকভাবে। তারপরও বিদেশিদের দেওয়ার জন্য মরিয়া কেন, সেটি প্রশ্ন। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চুল পরিমাণ উন্নতি হয়নি। জনগণের জানমাল রক্ষায় উন্নতি নেই।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য ফেরদৌস আরা রুমী বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা নেই বলে, অর্থনীতি, পাট ও কৃষিকে বিদেশনির্ভর করা হয়েছে। কৃষিতে দেশি বীজের পরিবর্তে বিদেশি বীজ কোম্পানির বাজার তৈরি করা হয়েছে। দেশীয় গ্যাস কোম্পানি বাপেক্সকে পঙ্গু করে রেখে বিদেশি গ্যাস কোম্পানির হাতে দেশের গ্যাসসম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চট্টগ্রাম বন্দরও বিদেশিদের লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন এসএসএ কোম্পানির হাতে ১৯৮ বছরের লিজ দেওয়ার অসম চুক্তি করা হচ্ছিল। তখন বামপন্থীদের বন্দর রক্ষা কমিটি, তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনের মুখে চুক্তিটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এসব তথ্য-উপাত্ত ও সতর্কবার্তা কানে তুলতে নারাজ।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ৩০ জুলাই রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেকোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন রিটের শুনানিতে আদালত এই আদেশ দিয়েছিলেন। তবে রিট চলমান থাকা অবস্থায় সরকার নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।