গহিন বনের খালে লাশটা খুঁজে পেয়েছেন এটাই স্বজনদের সান্ত্বনা

সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকারে গিয়ে নৌকাডুবিতে নিহত জেলে নুরুল ইসলামের বাড়িতে স্বজনরা। রোববার সকালে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শেখ সরদারপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পাশাপাশি কয়েকটি ঘর। মাঝখানের ঘরটির উঠানে চেয়ার পেতে বসে আছে প্রতিবেশী-স্বজন। ঘরের ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এ ছাড়া পুরো বাড়িই এক রকম সুনসান। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সুন্দরবনের নলবুনীয়া খাল থেকে ভাসমান অবস্থায় বাড়ির মালিক বনজীবী নুরুল ইসলামের (৪৮) লাশ উদ্ধার হয়েছে।

পশ্চিম প্রান্তের ঘরটির বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন নুরুল ইসলামের স্ত্রী নুরজাহান বেগম। তাঁর পাশেই বসেছিলেন কয়েকজন প্রতিবেশী নারী। ঘরের সামনে দিয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে দেখা যায়, নতুন একটি কবর নেট দিয়ে ঘিরে রাখা। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নুরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে এমদাদুল হক (২৫)।

ঘরের ভেতর ডুকরে কাঁদছিলেন নুরুল ইসলামের মেয়ে তাসলিমা খাতুন (১৯)। পাশেই ছিলেন অন্য স্বজনেরা। ‘গহিন বনের নদী খালে তিন দিন দিনরাত খুঁজে অন্তত চাচার লাশটি পেয়েছি, এটাই আমাদের জন্য বড় সান্ত্বনা’ বললেন নুরুল ইসলামের ভাইপো হেলাল হোসেন।

নুরুল ইসলাম খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শেখ সরদারপাড়া গ্রামের জব্বার শেখের ছেলে। উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বড়বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপর পাশের সড়ক ধরে মোটরসাইকেলে ৫ মিনিট এগোতেই ডান পাশে পড়ে সরু একটি গ্রামীণ সড়ক। স্থানীয় লোকজনের তথ্যে আঁকাবাঁকা সেই পথ ধরে আর কিছু দূর এগিয়ে যেতেই নুরুল ইসলামের বাড়ি।

হেলাল বলেন, তাঁর চাচা জেলে ছিলেন। সুন্দরবন ঘিরেই তাঁর জীবিকা। গত ১৯ নভেম্বর বন বিভাগের কাশিয়াবাদ স্টেশন থেকে কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে বনের নদীতে যান নুরুল ইসলাম। গত সোমবার রাতে কাঁকড়া ধরা শেষে ফেরার সময় সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির আওতাধীন ঝপঝপিয়া নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নৌকায় থাকা জাকির হোসেন নামের এক জেলে সাঁতরে নদীর তীরে উঠে আসেন। তবে ডুবে যান নুরুল ইসলাম।

বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের নদীতে তিন দিন উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে তাঁর কোনো খোঁজ পাননি বন বিভাগের সদস্যরা। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে সুন্দরবনের ঝপঝোপিয়া নদীসংলগ্ন নলবুনীয়া খালে নুরুল ইসলামের লাশ ভেসে উঠলে উদ্ধার করে লোকালয়ে আনা হয়। ওই দিন দুপুরে লাশ বাড়িতে আনার পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

হেলালের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা বলতে দেখে বাবার কবরের পাশ থেকে হেঁটে আসেন ছেলে এমদাদুল হক। বললেন, ‘বাবা সুন্দরবনের নদী–খালে মাছ কাঁকড়া শিকার করতেন আর আমি এলাকায় থেকে ভ্যানগাড়ি চালাতাম। কয়েক দিন আগে আমার ভ্যানের মোটর নষ্ট হয়ে গেছে। আব্বা সুন্দরবনে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, বন থেকে ফিরে আমার ভ্যানের জন্য নতুন মোটর আর ব্যাটারি কিনে দেবেন। আমি কোনোরকমে ভ্যানে মোটর লাগাতে পারলেও আমার আব্বারে তো আর পাব না।’

ছেলের কথা শুনে মা নুরজাহান বেগমও কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার খোকার আব্বা প্রতিবার বনে গেলি সাত-আট দিন পর ঠিক বাড়িতে আসত। বনের মধ্যে কোথাও মোবাইলের নেটওয়ার্ক পালি বাড়ি ফোন দিত, কথা কইতো। এবার একদিনও ফোন দিইনি। আমি ওনার পথ চেয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। মানুষটা আসলো তা–ও লাশ হয়ে।’

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নুরুল ইসলাম খুব সহজ-সরল ছিলেন। এলাকাবাসীর কাছে খুব প্রিয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি ডুবতে বসেছে। যেহেতু তিনি সুন্দরবনের নিবন্ধিত জেলে ছিলেন, তাই বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় তাঁর পরিবারকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার দাবি করেন এই জনপ্রতিনিধি।