পাবনা
অন্ধকার থেকে আলোর পথে শিশু–কিশোরেরা
১৪২ জন নানা অপরাধে কারাগারে ছিল। গত এক বছরে তাদের কয়েকটি শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তারা এখন ভালো কাজ করছে।
শিশু বয়সে অপরাধে জড়িয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন তিনি। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়ালেখা। শিশু থেকে হয়ে উঠছিলেন তরুণ। হতাশা নেমে এসেছিল জীবনে। এর মধ্যেই প্রবেশন পান তিনি। এইচএসসি পাস করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে শিশু বয়সে কারাগারে গিয়েছিল আরেক কিশোর। হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় পৈতৃক ব্যবসা। এতে অসহায় হয়ে পড়েছিল তার পরিবার। প্রবেশনে মুক্তির পর বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে সে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার পরিবার।
গত এক বছরে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া পাবনার ১৪২ শিশু, কিশোর ও তরুণ আদালত থেকে প্রবেশনে মুক্তি পেয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ শিশু আদালতের বিচারক মিজানুর রহমান কয়েকটি শর্তে তাদের প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন। এই শিশুরা এখন তাদের ভুল বুঝতে পেরে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর পথের যাত্রী হয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা এই শিশুদের নিয়মিত তদারক করছেন।
আদালত ও প্রবেশন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জামিনে মুক্ত ১৪২ জনের বয়স ৯ থেকে ২০ বছর। তারা মাদক সেবন, মাদক ও অস্ত্র বহন, মারধর ও চুরির অভিযোগে হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিল। বিচারপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে দোষ স্বীকার, পড়ালেখা করা, সঠিক পথে ফিরে আসা এবং সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে তাদের এক থেকে তিন বছরের জন্য প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রবেশনে মুক্তি পাওয়া শিশু–কিশোরদের মধ্যে ৭৪ জন পড়ালেখা শুরু করেছে। বাকিদের মধ্যে সাতজন পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেছে। একজন শহরের একটি রেস্তোরাঁয় চাকরি করছে। বাকিরা পরিবারকে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে।
প্রবেশনে মুক্তির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ওই তরুণ (২০) বলেন, সাত মাস আগে প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেযন। পাস করে তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়েছেন। তিনি আদালতের দেওয়া শর্ত যথাযথভাবে মেনে চলছেন। ভবিষ্যতে আর কোনো অপরাধে জড়াবেন না। এতে তাঁর নিজের জীবনে নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। পরিবারও তাঁর ওপর ভীষণ খুশি রয়েছে। সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারছেন।
চাটমোহরের এক কিশোর তার পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেছে। সে জানায়, তার বাবা মুরগির ব্যবসা করতেন। সে কারাগারে থাকতেই বাবার মৃত্যু হয়। তখন ভাইবোন নিয়ে তার মা খুব বিপদে ছিলেন। মুক্তির পর সে বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। এখন মা, ভাইবোন নিয়ে বেশ ভালো আছে।
মুক্তির পর একজন জেলা শহরের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় চাকরি করছে। কথা হলে সে বলে, ‘অপরাধ জীবন মানেই অন্ধকার। জীবনটা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল। মুক্তির পর আলোর সন্ধান পেয়েছি। আদালতের শর্ত মেনে চলছি। আশা করছি, ভালো কাজ করে একদিন পুরোপুরি মুক্তি পাব। জীবনকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলব।’
প্রবেশনে মুক্তি পাওয়া শিশুদের নিয়মিত তদারক করেন জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রবেশনের মেয়াদে শিশুরা তাদের শর্ত পূরণ করলে তারা সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পাবে।
জামিনে মুক্ত এসব শিশু, কিশোর ও তরুণের খোঁজ রাখেন পাবনা জেলা পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশু–কিশোররা নিজের অজান্তেই অপরাধে জড়ায় বলে মনে হয়। প্রবেশনে মুক্তি পাওয়ার পর অধিকাংশ শিশুই তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে।
এ বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা পল্লব ইবনে শায়েখ বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত এসব শিশুর খোঁজ নিচ্ছি। তাদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। কারও আর্থিক সংকট থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাদের আইনগত সহযোগিতাও দেওয়া হচ্ছে। এসব শিশু এখন আলো ও অন্ধকার জীবনের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে। আগামী দিনে তারা আরও ভালো থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।’