জন্মভূমি ‘রাখাইনে’ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রোহিঙ্গারা

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরফাইল ছবি

প্রায় সাত বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর সিকদারপাড়া থেকে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ পালিয়ে আসেন রোহিঙ্গা রহিম উল্লাহ। এরপর মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। পাহাড়ের ঢালুতে ত্রিপলের ছাউনির ছোট্ট ঘরে ইতিমধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন টানা সাড়ে ছয়টি বছর। এই ঘরে জন্ম নেয় আরও তিন সন্তান। কিন্তু জন্মভূমিতে ফেরার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।

গতকাল বুধবার দুপুরে কথা হয় রহিম উল্লাহর সঙ্গে। তখন তিনি ঘরের সংস্কারকাজ করছিলেন। ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসের ঘটনায় তাঁর আশপাশের কয়েকটি ঘর চাপা পড়ে চারজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। বালুখালী ছাড়া চারটি আশ্রয়শিবিরে পৃথক ভূমিধসের ঘটনায় নিহত হন দুই বাংলাদেশিসহ আরও সাতজন রোহিঙ্গা।

রহিম উল্লাহ (৫২) বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে তৈরি ত্রিপলের ছাউনিতে নিরাপত্তা নেই। বর্ষায় ভূমিধস এবং শুষ্ক মৌসুমে আগুনের ভয় আছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের আনাগোনা লেগেই আছে শিবিরে। খুন, অপহরণসহ প্রতিদিন ঘটছে নানা অপরাধের ঘটনা। তাই সব মিলিয়ে শিবিরে বসবাসের কোনো পরিবেশ নেই। তবু শিগগির দেশে ফিরতে পারবেন, এমন আশা নেই তাঁর।

আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ দিবসকে ঘিরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ১৩ জুন জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর শিবিরগুলোতে খেলাধুলা-বিনোদনসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, গত বছর ৮ জুন উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে লাখো রোহিঙ্গা বাড়ি ফেরার ‘গো-হোম’ ক্যাম্পেইন করলেও এবার কর্মসূচির অনুমতি মেলেনি। পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সাম্প্রতিক মিয়ানমার সংঘাত-লড়াই পরিস্থিতি সেই উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। রাখাইনে ফেরা নিয়ে লাখো রোহিঙ্গা দুশ্চিন্তায় আছেন। চার মাস ধরে রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সংঘাত-লড়াই চলছে। আরাকান আর্মি মংডু টাউনের কিছু অংশ ছাড়া বিপুলসংখ্যক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। মংডু টাউন দখলে নিতে পারলে পুরো রাখাইন রাজ্য তাদের দখলে চলে যাবে। তখন রোহিঙ্গাদের কী হবে ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ, আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ রয়েছে।

রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত

রহিম উল্লাহর কিছুটা দূরে আরেকটি পাহাড়ের ঢালুতে থাকেন মংডুর উত্তরে বলিবাজার এলাকার রোহিঙ্গা কাদির হোসেন। তিনি প্রায় সাত বছর আগে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। কাদির হোসেন (৪৮) বলেন, রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেও ভালো না। আরাকান আর্মি সেখানকার সরকারি বাহিনীকে উৎখাত করে অধিকাংশ এলাকা দখলে নিয়েছে। মংডুর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের রাচিডং-বুচিডং শহরটিও দখলে নিয়েছে। সেখানকার অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা এখন বাস্তুহারা। অন্যদিকে মংডু টাউনে বসবাসকারী এক লাখের বেশি রোহিঙ্গাকেও উচ্ছেদের আল্টিমেটাম দিয়েছে আরাকান আর্মি। সব মিলিয়ে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ যেখানে (রাখাইনে) অনিশ্চিত, সেখানে বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকা ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দেশে ফেরার ইচ্ছা-দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। প্রায় সাত বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম থেমে নেই। কিন্তু টানা চার মাস ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই-সংঘাত প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে সেখানকার বেশ কিছু অঞ্চল আরাকান আর্মি দখল করেছে, প্রতিদিন সেখানে গোলাগুলি হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ।