যেভাবে প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বহদ্দারহাট

চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু এলাকায় শিক্ষার্থীদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছেন এক পুলিশ সদস্য। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তোলাফাইল ছবি

দিনভর প্রচণ্ড গোলাগুলি। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ছুড়ছিল রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল। সঙ্গে  মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ। পুলিশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দেন আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ), ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।

চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট মোড়ে এক বছর আগে আজকের এই দিনে ১৮ জুলাই এমন তাণ্ডব চলে। এরপরও দমে যাননি শিক্ষার্থীরা। গড়ে তোলেন শক্ত প্রতিরোধ। সে প্রতিরোধ সংগ্রামে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়াও। তবে সন্ধ্যার দিকে বিপরীত দিক থেকে আসা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। টানা পাঁচ দিন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৩ জুলাই সকালে মৃত্যু হয় হৃদয়ের।

গত বছরের ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ)’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিলেন বহদ্দারহাট মোড়ে। একদিকে তৎকালীন সরকার–সমর্থক সন্ত্রাসী বাহিনী, অন্যদিকে পুলিশের আক্রমণ সয়েও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাঁদের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন, ছেড়ে যাননি রাস্তা। এক বছর পার হলেও সেই দিনগুলোর কথা এখনো ভুলতে পারেননি আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে চট্টগ্রাম নগরে প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বহদ্দারহাট মোড়। আবার এই মোড় পরিণত হয়েছিল মৃত্যুকূপেও। এই আন্দোলনে চট্টগ্রাম নগরে নিহত ১৫ জনের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয় এই মোড়ে।

হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়া ছাড়াও জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বহদ্দারহাটে খুন হয়েছিলেন অটোরিকশাচালক শহিদুল ইসলাম, কলেজছাত্র তানভীর সিদ্দিকী, ফজলে রাব্বী ও দোকান কর্মচারী মোহাম্মদ সাইমন।

এই পাঁচ খুনের ঘটনায় পাঁচটিসহ চান্দগাঁও থানায় ১২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ লতিফ ও আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীকে।

বন্দুক-দা নিয়ে ছাত্রলীগ-পুলিশের হামলা

সেদিনের হামলার ঘটনা এখনো ভুলতে পারেননি বহদ্দারহাট মোড়ের ফলদোকানি মো. সিরাজুল ইসলাম। জানতে চাইলে দোকানের সামনে রাখা টুলে বসে স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরলেন সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘সকাল থেকেই ছেলেরা এখানে (বহদ্দারহাট মোড়) এসে জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করে। তবে ছাত্ররা পিছু হটেননি। একপর্যায়ে চান্দগাঁওয়ের ওদিক থেকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা বন্দুক, দা, কিরিচ নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলে পড়ে। তখন পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই সময় বাঁচতে দোকান বন্ধ করে পাশের কাঁচাবাজার মার্কেটে ঢুকি পড়ি। এর মধ্যে শুধু একটানা গুলির শব্দ শুনে গেছি।’

দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম চট্টগ্রাম নগরে আছেন ৩১ বছর ধরে। তিনি বলেন, বহদ্দারহাট মোড়ে যেভাবে হামলার ঘটনা ঘটেছে, সে রকম আগে কখনো দেখিনি।

আরাকান সড়কের বাদুড়তলা এলাকায় একটি গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকানের কর্মচারী ফাহাদুল ইসলাম ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এই তরুণ গত বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর আন্দোলনের সময় পুলিশ-ছাত্রলীগ ছাত্রদের অনেক নির্যাতন করেছে। গুলি করেছে। এরপরও ছাত্ররা অনেক সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু বিকেলের পর ছেলেদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে ভ্যানে করে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ–পুলিশের সংঘর্ষ
ফাইল ছবি

যেভাবে প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বহদ্দারহাট

১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির স্থান ছিল চট্টগ্রাম নগরের শাহ আমানত সেতু গোলচত্বরে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকে সকাল থেকে সেখানে জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা। আগেই সেখানে অবস্থান নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সকাল সোয়া ১০টায় শাহ আমানত সেতু এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। তবে তাঁরা অনড় থাকেন। একপর্যায়ে সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

তবে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ কালামিয়া বাজার, রাহাত্তরপুল এলাকা হয়ে বহদ্দারহাটে এসে পৌঁছায়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আগে থেকে বহদ্দারহাটে অবস্থান নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভন্ডুল করতে সকাল থেকে তৎপর ছিল পুলিশ। পরে যোগ দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের অনেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তবে শিক্ষার্থীরা সাহসের সঙ্গে তাঁদের প্রতিরোধ করেন।

মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ

১৮ জুলাই সকালে শুরু থেকেই বহদ্দারহাট মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল চট্টগ্রাম জেলার অর্থ সম্পাদক সুদীপ্ত গুহ। সেদিন কী হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে র‍্যাবের ধাওয়া খেয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আমরা কয়েকজন একটা মসজিদে আটকে পড়ি। কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর বের হয়ে আবার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যাই। এর মধ্যে আমাদের ছাত্ররা নানা দিক থেকে আসছিল। তারপর পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকে আমাদের ওপর। তবে আমরা কেউ পিছু হটিনি।’

তবে অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখলেও তা নিয়ে হতাশা আছে সুদীপ্তর। বিশেষ করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনো জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করতে না পারায় ক্ষুব্ধ। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়ান বিন কবির আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেদিনের ঘটনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই আমাদের কর্মসূচি ছিল মূলত নতুন ব্রিজ এলাকায়। কিন্তু পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পরে আমরা মিছিল নিয়ে বহদ্দারহাট এলাকায় গিয়ে জড়ো হই।’

কিন্তু শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বেলা দুইটায় তাঁদের অবস্থানের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ হামলা করে জানিয়ে রিয়ান বিন কবির বলেন, চান্দগাঁও আবাসিকের ফ্লাইওভারের দিক থেকে তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিল রামদা, ছুরি, হকিস্টিকসহ দেশীয় অস্ত্র। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, ফলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে এক পর্যায়ে পুলিশও গুলি করতে থাকে।

জীবনে প্রথমবারের মতো এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘টিয়ার শেলের ঝাঁজালো তীব্রতায় মনে হচ্ছিল চোখ যেন ঝলসে যাবে। অনেকেই রক্তাক্ত হয়। অনেকে শহীদ হয়। এখনো চোখ বন্ধ করলে সে ভয়াল দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে।’