বহু বছর আগে ইছামতী নদীর তীরে গড়ে ওঠে বান্দুরা বাজার। ব্রিটিশ আমলেই এটি ব্যবসাসমৃদ্ধ ‘গঞ্জ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। সেখানেই নন্দ কুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিক্রমপুর অনন্তদেব মিষ্টান্ন ভান্ডার’। পরে নাম বদলে হয় ‘শান্তি মিষ্টান্ন ভান্ডার’। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঘোষ পরিবার ধরে রেখেছে এ ব্যবসা। এলাকার মানুষের কাছে একনামে পরিচিত ‘শান্তির মিষ্টি’ হিসেবে।
সম্প্রতি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী দোকানটির কর্মীরা বেশ কর্মব্যস্ত। লাকড়ির চুলায় তৈরি হচ্ছে রসগোল্লা। পাশে দুধ জ্বাল দিচ্ছেন কারিগরেরা। দোকানের ক্যাশে বসে আছেন প্রবীণ সহদেব ঘোষ, হাসিমুখে ক্রেতাদের সামলাচ্ছেন। তাঁর দোকান-বাসা একই ছাদের নিচে।
প্রায় ৭০ বছর আগে সহদেব ঘোষ তাঁর বাবা মোহন লাল ঘোষের হাত ধরে এ ব্যবসায় নামেন। এখন বয়স ৯০ বছর। এ বয়সেও দোকানের দেখভাল করেন। সহদেব ঘোষ বললেন, এই ব্যবসাই তাঁর জীবনের অবলম্বন। তাঁর সন্তানেরা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকলেও ছোট ছেলে সুধীর ঘোষ তাঁর সঙ্গেই থেকে দোকান চালান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান তাঁরা।
কারিগর সিদ্দিকুর রহমান ১২ বছর ধরে কাজ করছেন এখানে। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু খাঁটি দুধের ছানা ব্যবহার করি। কোনো পানি বা ভেজালের সুযোগ নেই।’ দোকানের বিক্রয়কর্মী শ্যামল বলেন, ‘প্রতিদিন এত ক্রেতা আসে যে সামলানোই মুশকিল। তবে এই ভিড়েই আনন্দ লাগে!’
সহদেব ঘোষের ছোট ভাই মধু ঘোষ জানান, তাঁদের পরিবার প্রায় ১৩০ বছর ধরে এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পুরো বান্দুরা বাজারে একটাই মিষ্টির দোকান ছিল—এই শান্তি মিষ্টান্ন ভান্ডার। এখন প্রতিদিন ২০০-৩০০ কেজি মিষ্টি বিক্রি হয়, মৌসুমভেদে তা বাড়ে বা কমে। অনেকে ফোনে অর্ডারও দেন। তাঁদের দোকানে মিষ্টির দাম শুরু ২৮০ টাকা থেকে। সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা দামের মিষ্টি পাওয়া যায়। দেড় টাকা কেজি দরে মিষ্টি বিক্রি করে দোকানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে জানান মধু ঘোষ।
স্থানীয়দের ভাষ্য, ব্রিটিশ আমলে বান্দুরা ছিল নদীবন্দর ও ধানের আড়তের জন্য খ্যাত। খ্রিষ্টানপল্লির কারণে ব্যবসাও জমজমাট ছিল। সেই সময় থেকে শান্তি মিষ্টান্ন ভান্ডার স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করে।
বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী মো. মুকুল বলেন, সহদেবের মিষ্টির তুলনা নেই। রসগোল্লা, মালাইচপ, চমচম, দই, রসমালাই—সবই খাঁটি দুধের তৈরি। প্রতিদিন গ্রামের কৃষকেরা নিজের হাতে দুধ এনে দেন এ দোকানে।
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই তাঁরা সহদেবের মিষ্টির নাম শুনে আসছেন। কখনো ভেজাল মেশান না, এই সততাই দোকানটিকে আজও টিকিয়ে রেখেছে।
ছোটবেলা থেকেই সহদেব-মধু ঘোষের মিষ্টির প্রতি তাঁদের আলাদা টান উল্লেখ করে স্থানীয় উন্নয়নকর্মী শীতল রোজারিও বলেন, নবাবগঞ্জ, দোহার, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর অঞ্চলের খ্রিষ্টান সমাজে তাঁদের মিষ্টি খুবই জনপ্রিয়।
শান্তির মিষ্টি ভান্ডারের মিষ্টি বিদেশেও যায়। অনেকেই নিয়মিত এ দোকান থেকে মিষ্টি পাঠিয়ে থাকেন প্রবাসে থাকা স্বজনদের জন্য।
মিষ্টি নিয়ে ক্রেতাদের সন্তুষ্টি তো আছেই; দোকানের পরিবেশ, পরিবেশন নিয়েও তারা সন্তুষ্ট। নবাবগঞ্জ উপজেলা স্যানিটারি পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সহদেব ঘোষের দোকানের পরিবেশ ও মিষ্টির মান সন্তোষজনক। তাঁরা যেন এই মান বজায় রাখেন, সেটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ।
আশপাশের বাজারের অনেক মিষ্টির ব্যবসায়ীরও অনুপ্রেরণা ‘শান্তির মিষ্টি’। বান্দুরা বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাদাপুর বাজার। সেখানকার সুমন মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক সুমন মণ্ডল বললেন, ‘শত বছরের ঐতিহ্য এ প্রতিষ্ঠান (শান্তি মিষ্টান্ন ভান্ডার) সুনামের সঙ্গে টিকে আছে। এটি আমাদের এ ব্যবসায় উৎসাহ জোগায়।’