ট্রলারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত সাত জেলে পরিবারের পাশে নেই কেউ

ট্রলার দুর্ঘটনায় নিহত মোহাম্মদ ওসমানের মা এখনো শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। গতকাল দুপুরে ফদনারডেইল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম দিকের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে ফদনারডেইল গ্রামে কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষের বসতি। গ্রামটি কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। ১ সেপ্টেম্বর সকালে শহরের বাঁকখালী নদীর ৬ নম্বর ঘাট এলাকায় গ্যাসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একটি মাছ ধরার ট্রলারের ১২ জেলে দগ্ধ হন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন সাত জেলে। নিহত জেলেদের অধিকাংশের বাড়ি ভোলা, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, চকরিয়াতে হলেও তাঁরা এক যুগের বেশি সময় ধরে পরিবার নিয়ে থাকছেন ফদনারডেইল গ্রামে।

দুর্ঘটনার ২০ দিন পরও নিহত সাত জেলে পরিবারের খোঁজ নেননি ট্রলারের মালিক মোহাম্মদ সেলিম। কক্সবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে পরিবারগুলোতে কিছু ত্রাণসহায়তা দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত জোটেনি সরকারি-বেসরকারি সহায়তা। খেয়ে না খেয়ে মানবেতর-দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত সাত জেলের মৃত্যু হলেও এখন পর্যন্ত থানায় মামলা করেননি কেউ। ট্রলারমালিকেরও খোঁজ নেই।

কক্সবাজারে ট্রলারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত ছেলে শফিকুল ইসলামের শোকে কাতর মা আমিন বেগম। গতকাল দুপুরে ফদনারডেইল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দিন কাটছে না জেলে পরিবারগুলোর

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ১২ জেলের মধ্যে এ পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ ওসমান গণি (২০), শফিকুল ইসলাম (২৮), দিল মোহাম্মদ (৩৩), রহিম উল্লাহ (৩০), আরমান (২২), শাহিন আলম (৩৬) ও রহিম উল্লাহ (৪২)। দগ্ধ অপর পাঁচজনের মধ্যে আইয়ূব আলী (৫৫) ও মনির হোসেনের (২৬) অবস্থা সংকটাপন্ন। দুজনের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

কক্সবাজার শহর থেকে সমুদ্র উপকূলের সড়ক ধরে পাঁচ কিলোমিটার গেলে সমিতিপাড়া বাজার। সেখান থেকে পূর্ব দিকে দেড় কিলোমিটার গেলে ফদনারডেইল গ্রামের একপাশে নিহত জেলে শ্রমিক শফিকুল ইসলামের টিনশেডের ঘর। সরকারি খাস জমিতে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার মানুষের ঘরবাড়ি।
গতকাল বুধবার দুপুরে শফিকুলের ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, দরজায় দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন মা আমিনা বেগম (৫২)। পরিবারের কয়েক সদস্য তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শফিকের মৃত্যুর ১৫ দিন আগে আমিনার বাঁ চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। চোখের ক্ষত এখনো সেরে ওঠেনি। তারপরও ছেলের শোকে সেই চোখ দিয়ে প্রতিনিয়ত ঝরছে বেদনার অশ্রু।

আমিনা বেগম বলেন, ছেলেটা সাগরে নামতে চাইতো না। আয় রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থা এলাকায় ছিল না বলে বাধ্য হয়ে সে ট্রলারে গিয়েছিল।

ঘরে ১৩ মাস বয়সী নাতি, পুত্রবধূ নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না জানিয়ে আমিনা বেগম বলেন, খেয়ে না খেয়ে টানাপোড়েনের সংসারে দুর্বিষহ জীবন কাটছে। ছেলে মারা যাওয়ার পর পৌরসভার পক্ষ থেকে একবার ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এরপর সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ঘটনার ২০ দিন অতিক্রান্ত হলেও ট্রলারমালিক মোহাম্মদ সেলিম অর্থসহায়তা দেবেন দূরের কথা, একবারের জন্যও তাঁদের দেখতে আসেননি।

শফিকুলের স্ত্রী তসলিমা আক্তার (২১) বলেন, দগ্ধ হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেলের আইসিইউতে দুই দিন ছিলেন শফিকুল। সেখানে দগ্ধ বাবার যন্ত্রণা দেখেছে ১৩ মাস বয়সী মেয়ে সুমাইয়াও। ৫ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে শফিকুল মারা গেছেন। এমন শোকের সময়ে মেয়ে সুমাইয়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ৯ দিন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল মেয়েটি। গত শুক্রবার সুমাইয়াকে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন তিনি। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়েকে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না। ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো যাচ্ছে না।

আমিনার বাড়ির পাশে নিহত জেলে মোহাম্মদ ওসমানের (২০) ঘর। ঘরে আছেন ওসমানের স্ত্রী, মা ও বাবা। ওই বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে চাইলে ওসমানের স্ত্রী জান্নাতুল ওয়াকিয়া (১৮) এগিয়ে আসেন। স্বামীর প্রসঙ্গ উঠতেই নীরবে চোখের জল ফেলেন তিনি। ওয়াকিয়া বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি। তাঁর স্বামী অনাগত সন্তানের মুখ দেখবে না, এটা ভাবলেই সব অন্ধকার হয়ে আসে। অনাগত সন্তানও কখনো বাবার মুখ দেখবে না। ওসমানকে হারিয়ে তাঁর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।

ফদনারডেইল গ্রামের সুলতান আহমদের ঘরে থাকতেন টেকনাফের জেলে দিল মোহাম্মদ (৩৩)। এক যুগ আগে সুলতানের বড় মেয়ে শফিকা আক্তারকে বিয়ে করেন দিল মোহাম্মদ। ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরে চালাতেন সংসার। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় দিল মোহাম্মদের মৃত্যু হলে দিশা হারিয়ে ফেলেন শফিকা। সংসারে তিন ছেলেমেয়ে।

শফিকা বেগম বলেন, তিন ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার প্রবল ইচ্ছা দিল মোহাম্মদের। এখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। বড় মেয়ে ইসমত আরা (৯) পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে, ওমর ফারুক (৮) দ্বিতীয় এবং আরমান (৫) পড়ছে নার্সারিতে।

নিহত অপর চার জেলে পরিবারেও মানবেতর জীবন কাটছে জানিয়ে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ঘটনার ২০ দিন অতিক্রান্ত হলেও নিহত সাত জেলে পরিবারের সদস্যরা পৌরসভা ছাড়া অন্য কারও সহায়তা পাননি। নানা চেষ্টা করেও ট্রলারমালিক সেলিমকে পাওয়া যাচ্ছে না। অসহায় পরিবারগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছেন না তিনি।

এ প্রসঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও ট্রলারমালিক সেলিমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে।