পানি উঠছে না নলকূপে 

উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ পাম্প ও নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। 

বসতবাড়ির সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না। গত শনিবার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের রংপুরিয়াপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নলকূপের হাতলে ৮৮ বার চাপ দিয়ে ১৬ লিটারের এক বালতি পানি পেয়েছেন পার্বতী দাস (৪১)। কোনো কোনো দিন আরও কম পানি পাওয়া যায়। পাঁচ-সাত বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তিনি। 

পার্বতীর বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাহানপুর গ্রামে। পার্বতী দাস বলেন, সংসারে পাঁচজন সদস্য। বর্ষা মৌসুমে ঠিকঠাক পানি পেলেও শীত ও খরা মৌসুমে পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। বাড়ির নলকূপটির গভীরতা ১৮০ ফুট। এক বালতি পানির জন্য হাত ও কোমরে ব্যথা হয়ে যায়। সংসারে ছোট বাচ্চা। অনেক পানির দরকার। বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি আনেন। এলাকার প্রায় সব বাড়িতে পানি সংরক্ষণের জন্য আলাদা বালতি ও ড্রাম রাখা আছে।

পার্বতীর মতো পানির জন্য এমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ইউনিয়নের প্রায় ৩২ হাজার মানুষ। গত শনিবার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাহানপুর, শীলপাড়া, মাস্টারপাড়া, সেনপাড়া নদুডাঙ্গী, কর্মকারপাড়া, নিপুণপাড়া, চকপাইকপাড়া, শিবডাঙ্গী এলাকা ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব এলাকার অধিকাংশ সাধারণ পাম্প ও নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। ফলে সুপেয় ও গৃহস্থালির কাজে পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন তাঁরা। উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রচণ্ড দাবদাহ, পুকুর ও জলাশয় ভরাট হওয়ায় পানির সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

রংপুরিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী আক্তার (২৮) বলেন, ‘অনেক সময় মোটর চালু করেও পানি পাই না। আমাদের বাড়ির তিন দিকে বরেন্দ্রের তিনটি গভীর নলকূপ আছে। এ জন্য বাসাবাড়ির নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। বৃষ্টি হলে সামান্য আসে। মাঝেমধ্যে পাশের পাড়ায় ননদের বাড়িতে গিয়ে গোসল করি। বালতিতে পানি নিয়ে আসি। অনেকে এলাকার মসজিদের সাবমারসিবল পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করেন।’

নদুডাঙ্গী এলাকার মাছচাষি সমিরউদ্দিন বলেন, ‘বছর চারেক আগেও পুকুরে মাছ চাষ করছি। এখন পুকুরে পানি থাকে না। মেশিন দিয়েও পানি ওঠানো যায় না। কয়েক বছর থেকে মাছ চাষ বন্ধ। এলাকার ৯০ ভাগ পুকুরে পানি নেই। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে বরেন্দ্র প্রকল্পের গভীর নলকূপ থেকে।

ইউনিয়নের চকপাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুশীল চন্দ্র রায় (৫০) ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নলকূপ বসানোর কাজ করছেন। তিনি বলেন, ১৫ বছর আগেও ৭০-৮০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যেত। পাঁচ বছর ধরে যেসব বাড়িতে নলকূপ বসিয়েছি গড়ে ১৭০-২১০ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ১০০ ফুট গভীরতায়ও পানি পাওয়া যায়। তবে আয়রন বেশি হওয়ায় সেই পানি পান করা যায় না।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোপাল দেব শর্মা বলেন, পুরো ইউনিয়নে ৩২ হাজার মানুষের বসবাস। সাত-আট বছর ধরে এলাকায় খরার সময় পানির সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে। নদীনালা-পুকুরগুলোতেও পানি থাকছে না। কোথাও আগুন লাগলে নেভানোর জন্য পানি পাওয়া মুশকিল হবে। পানির স্তরটা নেমে যাওয়ায় এই বিড়ম্বনা। জানালেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ইউনিয়নে ২৬টি সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। এ কারণে দুর্ভোগ কিছুটা কমেছে। তবে আরও কিছু পাম্প বসানো দরকার। 

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এন মো. নাইমূল এহসান বলেন, ‘বীরগঞ্জ উপজেলার কিছু জায়গায় পানির সংকট আগে থেকেই ছিল। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে সংকটটা বেড়েছে। পানির স্তর ৪৫-৫০ ফুট নিচে নেমে গেছে। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ২৬টি সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

অন্যদিকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, জেলায় কৃষিকাজে সেচ–সুবিধার জন্য উপজেলায় ২৯২টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু মোহাম্মদপুর ইউনিয়নেই রয়েছে ২১টি গভীর নলকূপ।

পানির সংকট ও স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল শারীরতত্ত্ব ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শ্রীপতি সিকদার বলেন, জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। যখন অধিক বৃষ্টিপাত হয়, তখন নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যায়; অন্যদিকে খরার সময় পানি ওঠে না। কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় গভীর নলকূপ বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।