বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলা

কেউ কঠিন বিষয়েও প্রাইভেট পড়তে পারেনি, কেউ হেঁটেই দূরের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছে। কেউ মাটি কাটার শ্রমিকের কাজ করেছে।

কারও পরিবারে অভাব–অনটন লেগেই আছে। কারও পরিবারে কলহ। পড়াশোনার খরচ জোগাতে কেউ মাটি কাটার শ্রমিকের কাজ করেছে। কেউ আবার টিউশনি করেছে। কেউ কঠিন বিষয়েও প্রাইভেট পড়তে পারেনি, কেউ হেঁটেই দূরের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেছে। এমন সব অদম্য শিক্ষার্থীরা মেধার স্বাক্ষর রেখেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষায়। সবাই জিপিএ–৫ পেলেও এখন কলেজে পড়াশোনার খরচ জোগানো নিয়ে চিন্তায় পড়েছে এই মেধাবীরা।

এখনো স্কুলে বেতন বাকি পুষ্পিতার

বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াত করত পুষ্পিতা রানী শীল। বিদ্যালয়ে কোচিং করলেও বাইরে কোনো প্রাইভেট পড়তে পারেনি। দরিদ্র বাবার পক্ষে বিদ্যালয়ের বেতন দেওয়াও সম্ভব হতো না। এমনকি এখনো পাঁচ মাসের বেতন বাকি। এমন নানা সংকটের পরও জিপিএ-৫ পেয়েছে পুষ্পিতা।

বিজ্ঞানের ছাত্রী পুষ্পিতার বাড়ি নীলফামারী সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের কবিরাজপাড়া গ্রামে। তার বাবা সুভাষ চন্দ্র শীল নরসুন্দর। মা মিনতি রানী শীল গৃহিণী। তাদের ১০ শতাংশের ভিটাটুকুই সম্বল। তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট পুষ্পিতা। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।

পুষ্পিতা বলে, ‘বাবার কাছে কখনো কোনো আবদার করলে বাবা দিতে না পারলে আমি কষ্ট পেতাম না। দিতে না পারার জন্য বাবাই কষ্ট পেত। আমার এবং বাবার ইচ্ছা, আমি লেখাপড়া করে একজন নার্স হব। সে পর্যন্ত যেতে আমাকে অনেক পড়তে হবে। কিন্তু বাবার পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।’

কালীতলা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুধীর রায় বলেন, ‘মেয়েটা অনেক মেধাবী। তার পরিবার অত্যন্ত গরিব। প্রাইভেট না পড়েও এত ভালো ফলাফল করেছে। এখন তাকে কেউ সহযোগিতা দিলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।’

মাটিকাটা কাজ করে জিপিএ-৫ সাইফুরের

সাইফুর রহমানের বয়স যখন ছয় মাস, তখন বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। এর বছর তিনেক পর মা অন্যত্র সংসার পাতেন। সেই থেকে ছোট্ট শিশু সাইফুরকে কোলেপিঠে করে অনেক কষ্টে বড় করেন নানি আফতেরা বেগম। এখনো ৭০ বছর বয়সী নানিই সাইফুরের ভরসা। ছোটবেলা থেকেই নিজের পড়াশোনা, অন্যান্য খরচ জোগাতে গ্রামে মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে তাকে। 

সাইফুর রহমান এখন জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু খরচ নিয়ে চিন্তা শুরু হয়েছে। তবে যে করেই হোক লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় সাইফুর। সে বলে, ‘আমার অনেক কষ্ট। মা-বাবাকে পাইনি। নানি বড় করেছেন। কী হব জানি না, তবে লেখাপড়া করে ভালো কোনো কিছু করতে চাই।’ বলেই চোখের পানি ছেড়ে দেয় সাইফুর।

চরমহল্লা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ফয়েজ আহমদ বলেন, আর্থিক কারণে যেন তার এগিয়ে যাওয়াটা থেমে না যায়। সহযোগিতা পেলে সে আরও ভালো করবে।

চিকিৎসক হতে চায় মোহনা

সাংসারিক টানাপোড়েনে মা-বাবা আলাদা থাকেন। মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকে মোহনা আক্তার। মা–বাবার এই বিরোধ মোহনার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এ পর্যন্ত তাকে তিনবার স্কুল বদলাতে হয়েছে। তবে সব বাধাকে পেছনে ফেলে এসএসসি পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিল মোহনা। ভালো ফল করায় মোহনা এখন রাজশাহীর একটা ভালো কলেজে পড়ালেখা করতে চায়। নাটোর সদর উপজেলার পণ্ডিত গ্রামে মামা আবদুল আজিজের জমিতে এক কক্ষের কাঁচা বাড়িতে মাকে নিয়ে বসবাস করে। তার মা মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘মোহনা ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই। ওর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। আমি চাই না, ওর জীবনটা আমার মতো হয়ে উঠুক।’

মোহনার মামা আবদুল আজিজ শারীরিক প্রতিবন্ধী। জায়গাজমিও তেমন একটা নেই। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে। সাহায্য–সহযোগিতা নিয়ে মোহনার পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। এখন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কী করে তাকে পড়ালেখা করাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।

মোহনা আক্তারের মতে, মা-বাবার দ্বন্দ্ব তাকে সব সময় তাড়া করে। তাই সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। উচ্চশিক্ষা নিয়ে সে মানসিক চিকিৎসক হতে চায়। তার মতো যারা পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত, তাদের পাশে থাকতে চায়।

দুই ভাইয়ের পর সাকিবেরও জিপিএ–৫

বড় দুই ভাইয়ের পর একই বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেল সাকিবুল হাসান। সে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা মুঞ্জুরুল আলম মুরগির খামারের কর্মচারী। বাবার পক্ষে সংসার চালানো অনেক কষ্টের বলে সাকিবুল নিজে গ্রামে প্রাইভেট পড়াত। সেই টাকা দিয়ে পড়াশোনার খরচ মেটাত।

সাকিবুল হাসান বলে, ‘বড় ভাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ মেটান। সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে আমাকে কিছু দেন। মেজ ভাই ফরিদপুরে পড়াশোনা করছে। সে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। আমাদের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের অন্যান্য খরচ বাবার একার পক্ষে মেটানো অসম্ভব। তাই মা নিজ থেকে কিছু হাঁস-মুরগি পালন করে চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে।’ সাকিবুলের স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া।

সাকিবুলের মা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার তিন ছেলেই মেধাবী, তাদের নিয়ে গর্ব করি। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। আমার তিন সন্তানকে সম্পদ হিসেবে গড়তে চাই।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী, খলিল রহমান, সুনামগঞ্জ, মুক্তার হোসেন, নাটোরএম রাশেদুল হক, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী]