পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।
শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।
১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে।
একনজরে জয়দেব
চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।
ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ।
পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে
খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।
জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে।
সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে।
জয়দেবের শিল্পবিশ্ব
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় মাস্টার্স শেষ করেছেন তখন। শিল্পী আবু নাসের রবির সঙ্গে চট্টগ্রামের পোড়াপাড়া আর্ট স্পেসে পারফরম্যান্স আর্ট নিয়ে কাজ করার সময় ২০০৯ সালে পরিচয় জাপানি শিল্পী সেইজি শিমুদার সঙ্গে। তাঁর আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে জাপানে যান। শিমুদা ছিলেন নিপ্পন পারফরম্যান্স আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা। সেখানে পারফরম্যান্সের জন্য জয়দেব যেসব খসড়া স্কেচ করেছিলেন, শিমুদার চোখ পড়ে সেসবে। দেখেই মুগ্ধ হন তিনি। স্কেচ খাতার ২০-২৫টি ড্রয়িং ছিঁড়ে আলাদা করে বাঁধাই করে বিক্রি করেন শিমুদা। বিদেশে সেই প্রথম ছবি এঁকে আয় জয়দেবের। বুঝতে পারলেন কেবল পারফরম্যান্স নয়, ছবি এঁকেও নিজেকে প্রকাশ করা উচিত তাঁর।
জয়দেবের নিখুঁত ডিটেলের কাজ দেখে মনে হয় ছাপচিত্র। এ পর্যন্ত তাঁর আঁকা কয়েক শ ছবি দেশ-বিদেশের গ্রাহকেরা কিনে নিয়েছেন। ‘প্রজন্ম কল্প দ্রুম ও অণু দ্রুম’ নামের একটি সিরিজে এ পর্যন্ত ৬০টির বেশি ছবি এঁকেছেন। এ ছাড়া ‘মা মাটি মমতা’, ‘আদিবাসী মানুষের ভবিষ্যৎ’, ‘তরল শিকড়’, ‘শিকড়ের সন্ধানে’ নামের বিভিন্ন সিরিজের আরও শতাধিক ছবি রয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে।
জয়দেবের ছবিতে আদিবাসী নারী, জুমিয়া পুরুষ অন্য সব উপাদানের চেয়ে বড়, বলা যায় মনুমেন্টাল। পাহাড়ের মানুষকে এমন দীর্ঘকায় দেখানোর এই চেষ্টা শিল্পী এস এম সুলতানকে মনে করিয়ে দেয়। সুলতান যেমন ভাবতেন তাঁর দেশের কৃষকেরা সবকিছু ছাপিয়ে নিজেদের দেহ সৌষ্ঠবের জন্য অনন্য, জয়দেবও হয়তো সে রকমটাই ভাবেন।
জয়দেবের ছবিতে দীর্ঘকায় পাহাড়ি নারীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে একবার বলেছিলেন, শৈশবে তাঁর দাদি সুবর্ণময়ী ত্রিপুরাকে দেখেছেন খুবই কড়া ধাতের। দাদাসহ সবাই তাঁকে ভয় পেতেন, মেনে চলতেন। আসলে পাহাড়ি সমাজটাই এমন। এখানে নারীরা বোঝা বয়। থুরুং কাঁধে পাহাড় পেরিয়ে চলাফেরা করেন। সংসারের বোঝাও তাঁরাই বহন করেন। তাই নারীরা এমন বড় হয়ে ওঠেন তাঁর ছবিতে।
পাহাড়ের কান্না
জাপানি শিল্পী সেইজি শিমুদার একটা কথা জয়দেবের মনে গেঁথে আছে। শিমুদা বলেছিলেন, মানবদেহই শিল্পীর ক্যানভাস। শিল্পীর ভাষা আসে তাঁর নিজের শরীর থেকে। শরীরটাই আর্ট।
জয়দেব সেই বয়ান নিয়ে আজও এগিয়ে যাচ্ছেন। শৈশব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যা কিছু তাঁকে ছুঁয়ে গেছে, সেটাই তিনি এঁকেছেন, পারফরম্যান্সে এনেছেন। কাপ্তাই হ্রদের নিচে নিমজ্জিত পাহাড় তাঁর অন্যতম শিল্পভাষা। সেই ভাষায় রাজনীতি আছে, আছে প্রতিরোধের ইশারাও।
জয়দেব বলেন, শৈশবে পাড়ার পাশেই ছিল চেকপোস্ট। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকের সেই দিনগুলোতে চেকপোস্টের সামনে দিয়ে যেতে বুক দুরু দুরু করত। যে মেয়েকে পছন্দ করতেন, তার উদ্দেশে প্রেমপত্র লিখেছিলেন। সেটা পকেটে নিয়ে হাঁটতে ভয় হয়েছে তাঁর। যদি ধরা পড়েন প্রেমপত্রসহ, তবে পাড়ার সবাই জানবে, বাড়ির লোকেরাও জানবে। গোপনীয়তা বলে কিছুই লালন করার উপায় ছিল না। তাই ছবিতে ঘুরেফিরে বন্দুক, চেকপোস্ট—এসব এসেছে।
জয়দেবের রেখা আর ডিটেইল তাই রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে। তবে সেই প্রশ্নের ভেতরে হিংসার ছায়া অনুপস্থিত। আছে কেবল কাতরতা আর বেদনার ভাষ্য।
বেশ কিছুদিন ধরে কাপ্তাই হ্রদে জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরছেন জয়দেব। তাঁর স্টুডিওর সামনের ঘাটে মাছ কিনতে গিয়ে এই জেলেদের সঙ্গে পরিচয়। জেলেরা সবাই একসময় জুমিয়া ছিলেন। কাপ্তাই হ্রদের নিচে খেতখামার ডুবে গেছে। জেলে বনে যাওয়া সেই জুমিয়াদের সঙ্গে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা থেকে জয়দেব আঁকা শুরু করলেন নতুন সিরিজ। নাম দিলেন, ‘পরিবর্তিত জীবন’। জল, মাছ আর আদিবাসী জুমিয়া মানুষদের সেই গল্প যেন পাহাড়ের কান্না।
শিল্পীর সংসার
জয়দেবের বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু জয়দেব তা চাননি। আর সে কারণে এসএসসি পরীক্ষায় ইচ্ছে করেই কম লিখলেন। ১৯৯০ সালে রেফার্ড পেয়ে এসএসসি পাস করে ভীষণ খুশি হন তিনি। মেডিকেল কলেজের দরজা এভাবে পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। ১৯৯১ সালে ভর্তি হন আর্ট কলেজে। সেখান থেকে প্রিলিমিনারিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে।
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী–পরিবার নিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন কাটে জয়দেবের। বাকি দুই দিন কাপ্তাইয়ের স্টুডিওতে। ব্যক্তিজীবনে সহপাঠী হাসনাহেনা পরশকে জীবনসঙ্গী করেছেন। পরশ-জয়দেব দম্পতির মধ্যে বোঝাপড়া কেমন—তা পরিচিতজনেরা জানেন। বলতে গেলে দুজনই শিল্পী সহকর্মী। একে অন্যের পরিপূরক। তাঁদের মেয়ের নাম তৈসা। জয়দেব জানালেন, তৈসা মানে ঝরনা। ভালো করে বলতে গেলে পাহাড়ি ঝিরি। ছেলের নাম ঈশান। জয়দেবের ছবি আঁকা ও শিল্পচর্চায় নিবিড়ভাবে সঙ্গ দেন স্ত্রী ও সন্তানেরা। তৈসা বাবার সঙ্গে পারফরম্যান্সেও অংশ নিয়েছে। এসবের বাইরেও জয়দেব দারুণ রান্না করেন। পাহাড়ির ঝিরির ছোট চিংড়ি, লেকের মাছ, মুরগির হেবাং কিংবা সবজির তোজা রান্নায় তাঁর জুড়ি নেই।
দীর্ঘ ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী জয়দেব সারাক্ষণ হাসেন। বলেন, ‘বাবার ইচ্ছা পূরণ না করার জন্য ইংরেজি পরীক্ষায় লিখতেই চাইনি।’ নিজেকে নিয়ে কোনো উচ্চাশা ছিল না তাঁর। চারুকলায় ভর্তি হওয়া, ছবি আঁকা—সবই করেছেন ভালো লাগা থেকে। ভালো লাগার পেছনেই ছুটেছেন আজীবন।