সময়মতো ময়নাতদন্ত, ডিএনএ ও ভিসেরা প্রতিবেদন না পাওয়ায় গাজীপুর মহানগরের আটটি থানায় গত ১০ মাসে আটকে আছে ৩৮৩টি মামলা। ফলে এগোচ্ছে না খুন, অপমৃত্যু, অজ্ঞাত লাশ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মামলার তদন্তকাজ। এসব প্রতিবেদন দেরিতে আসার কারণে ভুগতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের।
ভিসেরা প্রতিবেদনের অপেক্ষা
গাজীপুর জজকোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ডিএনএসহ মামলা–সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সময়মতো না পাওয়ায় অনেককে বিনা কারণে হাজতবাস করতে হচ্ছে। আবার অনেকে দোষী হয়েও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। তাই ডিএনএর মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন যাতে আরও দ্রুত পাওয়া যায়, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ময়নাতদন্ত, ডিএনএ, ভিসেরাসহ বিভিন্ন প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় মহানগরের আটটি থানায় ৩৮৩টি মামলার তদন্তকাজ থমকে আছে। এসব মামলার মধ্যে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছে ৮০টি মামলা; ভিসেরা প্রতিবেদনের অপেক্ষায় ৮টি এবং ডিএনএ প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছে ১৫২টি মামলা। এ ছাড়া মোবাইল ফরেনসিক প্রতিবেদন না আসায় ১১টি, এমসির ৩১টি, মাদকসংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য ৯৫টি মামলার তদন্ত ঝুলে আছে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে ছয়টি মামলার কার্যক্রম থমকে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব মামলার মধ্যে গাজীপুর সদর থানায় ৭৩টি, বাসন থানায় ৩১, কোনাবাড়ী থানায় ৩৯, কাশিমপুর থানায় ৩৫, গাছা থানায় ৫২, পুবাইল থানায় ২১, টঙ্গী পূর্ব থানায় ৯৫, টঙ্গী পশ্চিম থানায় ৩৭টি মামলা রয়েছে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয়নি, এমন মামলার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব মামলার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাদীর সাক্ষ্য প্রমাণ নেওয়া, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রকাশ্য ও গোপনীয়ভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। ডিএনএ, ভিসেরা বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে না পারায় তাঁদের মামলার বাদী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আদালতের কাছেও অনেক সময় হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। অনেকে মনে করেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই কাজ করছেন না অথবা সময়ক্ষেপণ করছেন।
আমরা আইনের বাইরে কিছু করতে পারি না। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া যেত।জাহিদুল ইসলাম, ওসি, পুবাইল থানা
বিভিন্ন প্রতিবেদনের কারণে জিএমপির পুবাইল থানায় থমকে আছে ২১টি মামলা। এ বিষয়ে এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আইনের বাইরে কিছু করতে পারি না। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া যেত।’
গত ১৮ আগস্ট ভোরে দক্ষিণ খাইলকুর বগারটেক এলাকায় প্রাইভেট কারের ভেতরে এ কে এম জিয়াউর রহমান ও মাহমুদা আক্তার ওরফে জলি দম্পতির লাশ পাওয়া যায়। জিয়াউর গাজীপুরের টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মাহমুদা টঙ্গীর আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। ঘটনার পরদিন নিহত শিক্ষকের ভাই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে গাছা থানায় হত্যা মামলা করেন। হতাশা প্রকাশ করে বাদী বললেন, তাঁর ছোট ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। কিন্তু ভিসেরা প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। পুলিশও তদন্ত থামিয়ে দিয়েছে।
গাছা থানার ওসি ইব্রাহীম হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত ভিসেরা প্রতিবেদন না পাওয়ায় শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর কারণ জানা যাচ্ছে না। যার কারণে সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তদন্তের কাজও থেমে আছে। থানাটিতে এমন আরও ৫২টি মামলা রয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
দেশে ভিসেরা পরীক্ষার একটিমাত্র ল্যাব আছে জানিয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইনে থাকতে হয়। পরীক্ষার প্রতিবেদন আসতে দেরি হওয়ায় মামলার তদন্তেও দেরি হচ্ছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্যও সময় লাগে। এসব প্রতিবেদনের জন্য অনেক সময় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও আটকে থাকে। এসব প্রতিবেদন দ্রুত পাওয়া গেলে তদন্তেও গতি পায়। তবে এই পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে প্রতিবেদন সংগ্রহ করার জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন তাঁরা।