প্রতিবন্ধীদের বন্ধু মাহাবুবুর

মাহাবুবুরের প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
প্রথম আলো

কেউ হুইলচেয়ারে বসে, কেউবা কোনোরকম দাঁড়িয়ে। শিক্ষকের কথামতো তারা হাত ওপরে তুলছে আবার নামাচ্ছে। এভাবেই চলছিল পাঠ শুরুর আগে শরীরচর্চা। তারা স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়, বিশেষ শিশু।

সমাজে যারা প্রতিবন্ধী শিশু হিসেবে পরিচিত। এই বিশেষ শিশুদের জন্য যিনি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের বিলপাড়-ডয়াইগাঁও গ্রামে এক অন্যন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তিনি নিজেও একজন প্রতিবন্ধী। শত বাধা পেরিয়ে তিনি যেমন সফল হয়েছেন ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে, সেই সফলতার পথে নিয়ে যাচ্ছেন সমাজের শিক্ষাবঞ্চিত বিশেষ শিশুদের।

প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ভালোবাসার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করে চলা মানুষটির নাম ম. মাহাবুবুর রহমান ভূঁইয়া। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম ‘মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ২৫ শতক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পাঠশালাটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০৭। যাদের অধিকাংশ অটিজম, বুদ্ধি, সেরিব্রাল পালসি ও ডাউন্স আক্রান্ত শিশু। পাঠশালার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মাহাবুবুরের গড়ে উঠেছে গভীর সখ্য।

মাহাবুবুরের জন্ম বাজিতপুরের পিরিজপুর ইউনিয়নের গোথালিয়া গ্রামের মুছা ভূঁইয়া ও সিন্ধু বেগম দম্পতির ঘরে। সালটি ১৯৭৭। তারিখ ১২ ডিসেম্বর। জেলার সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধীর বাস এই ইউনিয়নে।

মাহাবুবুর ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তবে তাঁর জীবনের গল্প অনেক কঠিন। জন্মের চার বছর পর তিনি পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। কোমর থেকে বাঁ পা চিকন হয়ে অবশ হয়ে যায়। তাঁর চলাফেরার ভরসা লাঠি। লাঠি ভর দিয়ে স্কুলে যেতেন। সহপাঠীরা খেলায় নিতেন না। একদিন প্রধান শিক্ষক তাঁর বাবাকে ডেকে বাংলা বাদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় পড়ানোর পরামর্শ দেন। শিক্ষকের দেখানো পথে হাঁটেন বাবা। পাঁচ মাইল দূরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। সেখানেও বিপত্তি। কিছুদিন না যেতেই মৌলভি সাহেব বাবাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, ‘ও তো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, ইমামতি করবে কীভাবে? হাতের কাজ শেখান। বড় হয়ে জীবনটা কোনোরকম চালিয়ে নিতে পারবে।’

এবারও মৌলভির পরামর্শ আমলে নেন বাবা এবং দরজির দোকানে দিয়ে দেন। এক বছর দরজির কাজ করতে হয়। পদে পদে বাধার পরও শেষে তিনি চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নিজের যাপিত জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ২০১০ সালে এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন’। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফাউন্ডেশনের অর্থসহায়ক। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি অসহায় প্রতিবন্ধীকে নানাভাবে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষ করে নিয়মিত পরিচালনা করা হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। দুই শতাধিক অসহায় প্রতিবন্ধী নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও বিনা মূল্যে ২০টির বেশি সেলাইয়ের মেশিন দেওয়া হয়েছে।

দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় এককালীন বৃত্তি ও শিক্ষা উপকরণ। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম, সফল শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, অসহায় ও প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক পুনর্বাসন জাকাত ফান্ড, শিক্ষার্থীদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গঠনে বিতরণ করেন বিনা মূল্যে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা। পাঠশালার সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিবন্ধী শিশুবান্ধব পাঠাগার ‘রোকেয়া বেগম আলোর কারখানা’। প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় প্রদান করা হয় ‘মৃত্তিকা সাংবাদিকতা অ্যাওয়ার্ড ও শিক্ষক সম্মননা’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের যে কটি উপজেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি, এর মধ্যে বাজিতপুর একটি। সর্বশেষ হিসাবমতে, এই উপজেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৬ হাজার ৭২২।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বাবুল মিয়া বলেন, মাহাবুবুরের মানবিক কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে। তাঁর এই মানবিক উদ্যোগের কারণে ঢাকায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতি থেকে সফল উদ্যোক্তা (সমাজসেবা) ক্যাটাগরিতে তিনি পুরস্কার পান।

মাহাবুবুর বলেন, মৃত্তিকার এক যুগের পথচলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেনের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, ডা. মেহেরুল হুদা পরিবার ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পাঠশালার পাশে প্রায় ৮০ শতক জমি কেনা হয়েছে। স্থানটিতে সুবিধাবঞ্চিত এতিম, পথশিশু ও প্রবীণ মানুষের জন্য আবাসনকেন্দ্র ও গ্রামীণ নারী শিক্ষার মডেল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কাজ করছেন।