রাজকীয় ভঙ্গিতে ফুট ট্রেইলে বসে ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার
বাংলাদেশের দক্ষিণের সবুজ বিস্ময় সুন্দরবন আবারও রোমাঞ্চ জাগিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। শনিবার (১১ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে পূর্ব সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া ইকো পর্যটনকেন্দ্রের ফুট ট্রেইলে দেখা মিলেছে এক বিশালাকৃতির রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। পর্যটক ও বনরক্ষীরা হঠাৎই দেখতে পান, বনের পথের মাঝখানে শান্তভাবে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে বাঘটি। যেন সে-ই এই বনের প্রকৃত অধিপতি।
অপ্রত্যাশিত এই দৃশ্য দেখে অনেকে থমকে যান, কেউবা মুঠোফোন হাতে মুহূর্তটি ধরে রাখেন। কয়েক সেকেন্ড পর বাঘটি মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকায়, আর বনপ্রহরীদের হাঁকডাকে ধীরে ধীরে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যায়। মুহূর্তেই ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ২৯ সেকেন্ডের সেই ভিডিওটি এখন সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
এত কাছ থেকে বাঘ দেখা সত্যিই এক বিরল অভিজ্ঞতা। পর্যটকেরা তখন ট্রেইলে হাঁটছিলেন, হঠাৎ সামনে এই দৃশ্য! আমরা দ্রুত সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে দিই এবং বাঘটিকেও বনে ফিরিয়ে দিই। এত কাছে বাঘ দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এটা একই সঙ্গে ভীতিকর ও রোমাঞ্চকর।কে এম রমজান আলী, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র
হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম রমজান আলী বলেন, ‘এত কাছ থেকে বাঘ দেখা সত্যিই এক বিরল অভিজ্ঞতা। পর্যটকেরা তখন ট্রেইলে হাঁটছিলেন, হঠাৎ সামনে এই দৃশ্য! আমরা দ্রুত সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে দিই এবং বাঘটিকেও বনে ফিরিয়ে দিই। এত কাছে বাঘ দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এটা একই সঙ্গে ভীতিকর ও রোমাঞ্চকর।’
এর আগেও সুন্দরবনে পর্যটকেরা এমন ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। খুলনার কয়রা উপজেলার বন বিভাগের সহযোগী হিসেবে কর্মরত সাইফুল ইসলাম জানালেন, গত আগস্টে সুন্দরবনের শেখেরটেক ইকো ট্যুরিজম এলাকায় গিয়ে তিনি হঠাৎই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান বন সংরক্ষক আসবেন শুনে আমরা এক দিন আগে ট্রলার নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। সকালে ট্রলার থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে সামনে যেতেই দেখি—ট্যুরিস্টদের বসার বেঞ্চের ওপর টান হয়ে শুয়ে আছে বিশাল এক বাঘ। মুহূর্তেই আমার রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে আবার ট্রলারে ফিরে আসি।’
এর আগে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বড় কটকা খালে বাঘ দেখেছিলেন পর্যটকবাহী জলযান ‘দি সেইল’–এর যাত্রীরা। বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন বড় কটকা খাল দিয়ে নৌযানটি চলার সময় হঠাৎ দেখা যায়—একটি বাঘ ধীরে ধীরে খাল পার হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাঘটি নদী পার হয়ে বনের গভীরে মিলিয়ে যায়।
এরও আগে, ১৯ জানুয়ারি কটকা অভয়ারণ্য এলাকায় একসঙ্গে তিনটি বাঘ দেখতে পান পর্যটকেরা। তাঁদের চোখের সামনেই ঘটে এক বিরল দৃশ্য—দুটি বাঘ মিলে অপর একটি বাঘকে আক্রমণ করে নদীতে ফেলে দেয়। এমন অবিশ্বাস্য মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে অভিভূত হন উপস্থিত সবাই।
হাড়বাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন শতাধিক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে জানা ছিল, বনের এই অংশে বাঘের বিচরণ রয়েছে, কিন্তু এবার দেখা গেল সরাসরি ফুট ট্রেইলে। এটা নতুন অভিজ্ঞতা, এবং এর মানে হলো—বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনকে বলা হয় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজ্য। একসময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপপ্রজাতি ছিল, কিন্তু এখন টিকে আছে মাত্র ছয়টি। তার মধ্যেও আকৃতি, সৌন্দর্য ও রহস্যে সুন্দরবনের বাঘ অনন্য। প্রাণিবিদদের মতে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কাদা, নদী ও গাছঘেরা কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই এদের দেহ তুলনামূলকভাবে ছোট, কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শক্তি ও অভিযোজন ক্ষমতায় তারা অপরাজেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের সব উপপ্রজাতির তুলনায় সুন্দরবনের বাঘ আকারে সবচেয়ে ছোট। সুন্দরবন ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারে বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়। তবে পার্থক্য শুধু দেহের আকারে—আচরণ ও রঙে তারা প্রায় এক।’
এই বাঘের গায়ের রং সাধারণত হলুদ থেকে হালকা কমলা, গা জুড়ে গাঢ় খয়েরি বা কালো ডোরা। পেট সাদা, লেজে কালো আংটির মতো দাগ। প্রতিটি বাঘের ডোরার নকশা একেবারেই আলাদা—যেমন মানুষের আঙুলের ছাপ। দুর্দান্ত সাঁতারু এই বাঘ সহজেই এক কিলোমিটার নদী পেরিয়ে যেতে পারে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা পায়ের ছাপ দেখে নির্ধারণ করতে পারেন, এটি পুরুষ বাঘের না স্ত্রী বাঘের।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বললেন, ‘হাড়বাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন শতাধিক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে জানা ছিল, বনের এই অংশে বাঘের বিচরণ রয়েছে, কিন্তু এবার দেখা গেল সরাসরি ফুট ট্রেইলে। এটা নতুন অভিজ্ঞতা, এবং এর মানে হলো—বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।’
২০১৮ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। সর্বশেষ ২০২৪ সালের হিসাবে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫–এ। অর্থাৎ ছয় বছরে বেড়েছে ১১টি বাঘ।