টাঙ্গাইলে শ্রমিক সমাবেশের নামে জেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের শক্তি প্রদর্শন

টাঙ্গাইলে মে দিবস উপলক্ষে সংসদ সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক এবং সংসদ সদস্য তানভীর হাসানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশের শোভাযাত্রা। আজ শহরে
ছবি: প্রথম আলো

মে দিবস উপলক্ষে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ আজ বুধবার পৃথক পৃথক স্থানে আয়োজন করেছিল শ্রমিক সমাবেশের। কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের কোনো প্রাধান্য ছিল না। দলীয় নেতারা এক পক্ষ আরেক পক্ষকে গালাগালির মধ্য দিয়ে পালন করলেন মে দিবস। এর মধ্য দিয়ে দুই পক্ষ তাঁদের শক্তি প্রদর্শন করলেন।

উভয় পক্ষের নেতা-কর্মীরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকের সমর্থকেরা এক পক্ষ। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা অপর পক্ষে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান নৌকা সমর্থকদের অংশের নেতা। দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম।

টাঙ্গাইল জেলায় সংসদীয় আসন আটটি। গত সংসদ নির্বাচনে এর মধ্যে একটি আসনে (টাঙ্গাইল-১) বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল না। বাকি সাতটি আসনে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। যার মধ্যে তিনজন নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। পাঁচটি আসনে নৌকার প্রার্থী জয় পেয়েছেন। সাতটি আসনে বিদ্রোহী সাত প্রার্থীর মধ্যে ছয়জনেরই প্রতীক ছিল ঈগল। একটি আসনে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীক ছিল ট্রাক (টাঙ্গাইল-৪ আসনে বিজয়ী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী)। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান বিরোধটি ‘নৌকা’ বনাম ‘ঈগল’-এর বিরোধ হিসেবে বেশি আলোচনা হচ্ছে।

সমাবেশ শেষে উভয় পক্ষ শোভাযাত্রা বের করে। দুই পক্ষের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শহরে উত্তেজনা দেখা দেয়।

নৌকা সমর্থকেরা জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের ব্যানারে শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে আজ মে দিবস পালনের উদ্যোগ নিয়েছিল। একই স্থানে সমাবেশের আহ্বান করে ‘ঈগল’ সমর্থক অংশের আওয়ামী লীগ। তারা পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সমাবেশের আয়োজন করে। প্রশাসন কোনো পক্ষকেই পৌর উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি।

টাঙ্গাইলে ঈগল প্রতীক নিয়ে বিজয়ী সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ও ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অপর অংশের শোভাযাত্রা। আজ শহরে
ছবি: প্রথম আলো

পরে নৌকা সমর্থকেরা জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের ব্যানারে শহরের শিবনাথ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী মো. আব্দুর রাজ্জাক। জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বালা মিয়ার সভাপতিত্বে নৌকা সমর্থকদের এই সমাবেশে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির, টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী অনুপম শাহজাহান জয় উপস্থিত ছিলেন। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসন থেকে নৌকা নিয়ে বিজয়ী খান আহমেদ শুভ নিজে সমাবেশে যোগ দেননি। তবে তাঁর সমর্থকেরা যোগ দেন। তাঁর বাবাই নৌকা সমর্থক অংশের নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান, যিনি বেলা ১১টায় ওই সমাবেশের উদ্বোধন করেন।

তবে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম ও তাঁর সমর্থকরা কেউ কোনো পক্ষের সমাবেশে আসেননি।

নৌকা সমর্থকদের সমাবেশে আরও ছিলেন গত সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে নৌকা নিয়ে পরাজিত কামরুল হাসান খান, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে নৌকা নিয়ে পরাজিত কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে নৌকা নিয়ে পরাজিত কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মামুনুর রশীদ। সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার আশরাফুজ্জামান স্মৃতি, যুগ্ম সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র সাহা, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র জামিলুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

ওই সমাবেশে প্রায় সব বক্তাই ঈগল পক্ষের আওয়ামী লীগের নেতাদের সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, দলের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য ওই পক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। কয়েক দশক ধরে জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে টাঙ্গাইলে মে দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তারা পৃথক সমাবেশের আয়োজন করেছে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের নিয়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নামে সমাবেশ করছেন। তাঁরা মূলত হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য নানা অপতৎপরতা শুরু করেছেন।

টাঙ্গাইল পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আওয়ামী লীগের অপর পক্ষ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে শ্রমিক সমাবেশ করে। এই সমাবেশে সাতটি আসনের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকেরা যোগ দেন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম। উদ্বোধন করেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন। প্রধান বক্তা ছিলেন টাঙ্গাইল-৩ আসন থেকে ঈগল নিয়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান।

পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল হকের সভাপতিত্বে এই সমাবেশে বক্তব্য দেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মির্জা মঈনুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ওয়াজির হাসান খান, পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উদয় লাল গৌড় প্রমুখ।

পৌর মেয়র এস এম সিরাজুল হক বলেন, একটি কুচক্রী মহল দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক সংগঠনগুলো দখল করে রেখেছে। তারাই শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অথচ তারা কেউ শ্রমিক নয়। তাদের হাত থেকে শ্রমিক সংগঠন রক্ষার জন্য পৌর শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এই পরিষদের উদ্যোগে শ্রমিক দিবস পালন করা হলো।

সমাবেশ শেষে উভয় পক্ষ শোভাযাত্রা বের করে। দুই পক্ষের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শহরে উত্তেজনা দেখা দেয়। শহরের বিভিন্ন মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিরালার মোড় থেকে বটতলা পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।