বেলাবতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সাধুসঙ্গে আসা লালনশিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র

নরসিংদীর বেলাবতে সাধুসঙ্গে আসা লালনশিল্পীদের ২০টি বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গতকাল রোববার দুপুরের এ ঘটনা ঘটে। ছবি তোলা সোমবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীর বেলাবতে এক লালনভক্তের চল্লিশা আয়োজন উপলক্ষে সাধুসঙ্গ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন ১০-১২ জন লালনশিল্পী। স্থানীয় মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের এক লালনভক্তের ড্রাগন বাগানের এক কোনায় গড়ে তোলা আশ্রমে শিল্পীরা প্রত্যেকে নিজেদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন।

ওই সময় স্থানীয় এক যুবক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সেখানে গিয়ে উৎপাত শুরু করেন। পরে শিল্পীরা তাঁকে বাগানের বাইরে বের করে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই যুবক কিছুক্ষণ পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হামলা চালিয়ে শিল্পীদের ব্যবহৃত অন্তত ২০টি বাদ্যযন্ত্র গুঁড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বেলাব উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল রোববার দুপুরে। আজ সোমবার সকাল থেকে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজনের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

ভুক্তভোগী শিল্পীরা বলছেন, স্থানীয় কয়েকজন এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাঁদের প্রশ্ন, বাদ্যযন্ত্রগুলোর কী দোষ ছিল? শিল্পীরা জানান, তাঁদের গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা, ডুগি, হাতবাড়া, খমক, দোতারা, সারিন্দা, গিটার ও বাঁশি। সব কটি বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।

হামলায় একটি পুরাতন সারিন্দা ভাঙা পড়েছে খোকন চিশতী নামের এক লালনশিল্পীর। দুঃখ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভেঙে দেওয়া আমার ব্যবহৃত সারিন্দাটি ছিল অন্তত ১৫০ বছরের পুরোনো। আমি আমার গুরুর কাছ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ এটি পেয়েছিলাম। এমন একটি সারিন্দা আমি আর কোথায় পাব? আমাকে মারধর করলেও এত কষ্ট পেতাম না, যতটা এই সারিন্দা হারিয়ে পাচ্ছি।’

বাবলা গ্রামে ড্রাগন বাগানটির মালিক ও আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম। আশ্রমটিতে প্রায়ই সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লালনশিল্পীরা যোগ দেন। আজ সোমবার প্রয়াত সুমন মিয়া নামের এক লালনভক্ত ব্যবসায়ীর চল্লিশা আয়োজনের কথা। এ উপলক্ষে রোববার সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানের ১০-১২ জন লালনশিল্পী ওই আশ্রমে এসে জড়ো হন।

বাগানটির মালিক ও আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক জানান, গতকাল দুপুরে ওই আশ্রমে বসে লালনের গান করছিলেন। ওই সময় জাহাঙ্গীর শেখ নামের স্থানীয় এক যুবক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সেখানে এসে উৎপাত শুরু করেন। পরে শিল্পীরা তাঁকে বাগানের বাইরে বের করে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জাহাঙ্গীর শেখ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর পরিবারের পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে সেখানে হামলা চালান। তাঁরা হুমকি দিয়ে শিল্পীদের ব্যবহৃত সব বাদ্যযন্ত্র লাঠি-রড দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই আশ্রম হচ্ছে লালনশিল্পীদের মিলনস্থল। সেখানে বিভিন্ন সময় যে সাধুসঙ্গ হয়, তাতে শিল্পীদের দাওয়াত দিয়ে আনতে হয় না, খোঁজ পেলে তাঁরা নিজেরাই চলে আসেন। স্থানীয় একজন লালনভক্ত ব্যবসায়ীর চল্লিশা উপলক্ষে সাধুসঙ্গের আয়োজন হয়েছিল। এতে অংশ নিতে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১০-১২ জন শিল্পী এসেছিলেন। লালনশিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়ার ঘটনার বিচার চাই আমি।’

লালনশিল্পী রনি জাবালী বলেন, ‘একজন শিল্পীর কাছে সব চেয়ে মূল্যবান হচ্ছে তাঁর বাদ্যযন্ত্র। এই বাদ্যযন্ত্রই যখন ভেঙে দেওয়া হয়, তখন সেটা হয়ে যায় আবহমানকালের লোক সংস্কৃতির ওপর সরাসরি আঘাত। দেশে ধর্মান্ধ একটি দল আছে, তারা চায় না আমরা লালনের গান করি। স্থানীয় উগ্র ধর্মান্ধ ব্যক্তিরাই হামলা চালিয়ে আমাদের সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দিয়েছে। আমরা এরই মধ্যে স্থানীয় থানার ওসি সাহেবকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছি।’

ঘটনার পর থেকে জাহাঙ্গীর শেখসহ হামলায় জড়িত থাকা সবাই এলাকা ছেড়েছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জাহাঙ্গীর শেখের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে একধিকবার কল করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শিল্পীদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি শোনার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি। যত দূর জানতে পেরেছি, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় এই ঘটনা ঘটিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এলাকায় নেই। এই ঘটনায় আমরা এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’