‘ছেলেকে ইতালি পাঠাতে দালালকে ২১ লাখ টাকা দিয়েছিলাম, এরপরও লাশ হতে হলো’
‘আপনারা এতটুকু করেন যেন আমার ভাইকে দেশে আনতে পারি, দেশের মাটিতে কবর দিতে পারি। আমার ভাইয়ের কবরে আমরা যেন মাটি যেতে পারি।’ আকুতিভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত এনামুল শেখের (২৮) ভাই নিজামুল শেখ।
১৩ নভেম্বর রাতে লিবিয়ায় ভূমধ্যসাগর–সংলগ্ন আল-খুমস উপকূলে দুটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার দুজন নিহত হন। তাঁরা হলেন উপজেলার ননিক্ষীর ইউনিয়নের পশ্চিম লওখন্ডা গ্রামের জাহিদ শেখের ছেলে আনিস শেখ (২৫) ও আকবর আলী শেখের ছেলে এনামুল শেখ (২৮)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁদের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারেন পরিবারের লোকজন।
এদিকে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ওই ঘটনায় মুকসুদপুর উপজেলার আরও ছয় যুবকের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন কাশালিয়া গ্রামের আওলাদ শেখের ছেলে ইব্রাহিম শেখ, হায়দার শেখের ছেলে আবুল শেখ, একরাম মিনার ছেলে দুলাল মিনা, হায়দার মিনার ছেলে আশিক মিনা, খালেক মোল্লার ছেলে সোহেল মোল্লা ও গুনহর গ্রামের হাফিজ মিনার ছেলে নিয়াজ মীনা।
নিহত দুজনের পরিবার জানায়, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় একটিতে ছিলেন বাংলাদেশের ২৬ জন নাগরিক। ঘটনার পর চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী কয়েক দিন তথ্য সংগ্রহের পর তাঁরা নিশ্চিত হন এনামুল ও আনিস নিহত হয়েছেন।
বুধবার বিকেলে পশ্চিম লওখন্ডা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এনামুল শেখের বাড়ির উঠানে চেয়ার পেতে প্রতিবেশীরা বসে আছেন। এনামুলের ভাইদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনেরা। একপর্যায়ে নিজেরাই কেঁদে ফেলছেন। তাঁরা জানান, এনামুল চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে গিয়ে তিনি নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
কথোপকথনের এক পর্যায়ে এনামুলের বাবা আকবর আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ থেকে রওনা হন এনামুল। ১৩ নভেম্বর রাতে লিবিয়ার আল-খুমস উপকূল থেকে নৌকায় ওঠেন তাঁর ছেলে। কিছু দূর যেতেই নৌকাটিকে ধাওয়া করে কোস্টগার্ড। পালাতে গিয়ে ডুবে যায় নৌকাটি। এতে এনামুল মারা গেছেন বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।
আক্ষেপের সুরে আকবর আলী আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে ইতালি পাঠাবে বলে মাদারীপুরের দালাল এনামুলকে ২১ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। এর পরও এনামুলকে লাশ হতে হলো।’
এনামুলের বাড়ির অদূরেই আনিস শেখের বাড়ি। তবে সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, ছোটবেলায় মাকে হারান আনিস। বাবা ও দুই বোনের সংসার। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে আনিস নিজেও বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স হিসেবে কর্মরত। তাঁদের সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে।
আনিসের প্রতিবেশী জয়নাল শেখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মারা যাওয়ার পরই আমাদের হুঁশ ফেরে। অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সব জেনেশুনে আমরা সর্বস্ব খুইয়ে প্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি। একটু ভালো থাকার আশায় এত টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠানো হয়। এখন সন্তানের লাশ ফিরবে কি না, সেই অনিশ্চয়তায় পরিবারগুলো। বিদেশ গমন বিষয়ে সচেতনতা, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং বিদেশে বৈধ অভিবাসন সুযোগ বাড়ানো ছাড়া এ মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।’
ননীক্ষির ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলমগীর মোল্যা বলেন, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশে যাওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও বেকারত্ব ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে এ পথ বেছে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, নিহত দুজন ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু তথ্য পাঠানো হয়েছে।