পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠির ভীমরুলি। নৌপথে আটঘর কুড়িয়ানা খাল থেকে ভীমরুলি যেতে হয় পেয়ারাবাগানের মধ্য দিয়ে। খালের পাশে গড়ে ওঠা এসব পর্যটনকেন্দ্র ও পেয়ারা পার্ক ৩০ থেকে ৪০ টাকায় টিকিট কেটে ঘুরে দেখা যায়; ইচ্ছেমতো খাওয়াও যায় পেয়ারা।
পেয়ারার মৌসুম প্রায় শেষ পর্যায়ে। চার থেকে পাঁচ দিন পর শেষ হবে। আমড়ার মৌসুম শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে। মূলত, এখানে পর্যটকদের ভিড় হয় পেয়ারার হাটকে কেন্দ্র করে। সেপ্টেম্বর থেকে যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁরা আমড়া ও পেয়ারা বেচাকেনা উপভোগ করেন।
সম্প্রতি এ প্রতিবেদক আটঘর কুড়িয়ানা ভাসমান হাট থেকে পেয়ারা পার্ক হয়ে ভীমরুলি যান। পিরোজপুর থেকে নেছারাবাদ উপজেলা সদর হয়ে সড়কপথে কুড়িয়ানা বাজার। কুড়িয়ানা বাজারে ভ্রমণের জন্য ট্রলার ও নৌকা পাওয়া যায়। একটি ট্রলার ভাড়া করা হলো। ট্রলারটি আটঘর কুড়িয়ানা খাল পেরিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ডিগ্রি কলেজের পাশ দিয়ে কুড়িয়ানা আদমকাঠি ভাড়ানি খালে ঢোকে। ১০ মিনিট ট্রলার চলার পর ভাড়ানি খাল থেকে আদমকাঠি বাজার খালে পৌঁছেই ভাসমান ‘পেয়ারা পার্ক’ দেখতে পাই। পেয়ারা পার্কের ঘাটে ট্রলার ভিড়িয়ে ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পার্কের ভেতর ঢুকে পড়ি। সেখানে পেয়ারাবাগানে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খাচ্ছেন। পার্কে রয়েছে খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ। পেয়ারা পার্কে কিছু সময় কাটানোর পর ট্রলারে রওনা হই। আধা কিলোমিটার এগোনোর পর রিয়ান পেয়ারা পার্কে আমরা পৌঁছে যাই। পাশেই রয়েছে ‘কটুরাকাঠি ন্যাচারাল ট্যুরিজম অ্যান্ড পিকনিক স্পট’ নামের আরও একটি পার্ক। পেয়ারাবাগানে পার্কগুলোয় রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। প্রতিটি পেয়ারা পার্কে আছে খাবারের ব্যবস্থা। আদমকাঠি কটুরাকাঠি ঘুরে ট্রলারটি ভীমরুলি খাল দিয়ে চলে যায় ঝালকাঠির ভীমরুলি বাজারে।
যাওয়ার পথে দেখা গেল, প্রচুর পর্যটক ট্রলার ও নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খালের পাড়ে পেয়ারাবাগানে নেমে ছবি তুলছেন কেউ কেউ। কেউ খালে সাঁতার কাটছেন। পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে আছে কুড়িয়ানা থেকে ভীমরুলি বাজার পর্যন্ত পুরো তিন কিলোমিটার নৌপথ। ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় তিন থেকে চারজনের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার ছোট–বড় ট্রলারে রয়েছে ১০ থেকে ৩০ জনের দল। রয়েছে ছোট লঞ্চও। দেশের বৃহত্তম ভাসমান বাজারের মধ্যে অন্যতম ভীমরুলি ভাসমান বাজার। সেখানে দেখা মিলবে ঢেউয়ের তালে তালে ছোট ডিঙিনৌকায় পেয়ারাসহ দেশীয় কৃষিপণ্যের বেচাকেনা। রয়েছে ব্যবসায়ীদের বড় বড় ট্রলার। কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে ট্রলারে ভরে নিয়ে যাওয়া হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভাসমান বাজারের পাশের সড়কে ট্রাকে পণ্য বোঝাই করে নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার খ্যাতি দেশজুড়ে। বর্ষাকালে পেয়ারার মৌসুমে আটঘর কুড়িয়ানা খালে পেয়ারা ভাসমান হাট বসে। ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় পেয়ারা বেচাকেনার দৃশ্য মুগ্ধ করার মতন। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে প্রতি শুক্রবার আটঘরের খালে ডিঙিনৌকার হাট বসে। ভাসমান হাটকে ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। মূলত, আটঘর কুড়িয়ানা খালের ভাসমান পেয়ারার হাট দেখে পর্যটকেরা নৌপথে পেয়ারাবাগান দেখতে দেখতে ঝালকাঠির ভীমরুলি ভাসমান হাটে চলে যান। এ বছর পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার কারণে পর্যটকের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে।
পাঁচ বছর আগে আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের কঠুরাকাঠি গ্রামে ১০ একর পেয়ারাবাগান বন্দোবস্ত নিয়ে তিন ভাই গড়ে তোলেন ন্যাচারাল ট্যুরিজম অ্যান্ড পিকনিক স্পট। গ্রামের খালের তীরে পেয়ারাবাগানে গড়ে তোলা পর্যটনকেন্দ্রটি দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পেয়ারাবাগানে ঘুরতে যাওয়া মানুষের পর্যটনকেন্দ্রটিতে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি খাওয়া সুব্যবস্থা রয়েছে।
ন্যাচারাল ট্যুরিজম অ্যান্ড পিকনিক স্পটের উদ্যোক্তা অর্ণব মজুমদার বলেন, ‘পেয়ারাবাগানে ঘুরতে আসা মানুষ চাষিদের বাগানে ঢুকে পেয়ারা খেতেন। এতে অনেক বাগানমালিক বিরক্ত হতেন। আমরা পরিকল্পনা করি একটি পর্যটন কেন্দ্র করার। যেখানে মাত্র ৩০ টাকা দিয়ে বাগানে প্রবেশ করে দর্শনার্থীরা ইচ্ছেমতো পেয়ারা খেতে পারবেন। ঘুরে বেড়াবেন। এ ছাড়া দর্শনার্থীদের খাবারের জন্য রয়েছে রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁয় প্রয়োজনীয় খাবার কিনে খাওয়া যাবে। আধা কিলোমিটারের মধ্য গড়ে ওঠা তিনটি পেয়ারা পার্কে ঘুরে বেড়ানো যাবে।’
ভীমরুলি ভাসমান বাজারের পাশে রয়েছে গৌরব পিকনিক স্পট ও রেস্টুরেন্ট। গৌরব রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক দীপংকর ঢালী বলেন, পেয়ারার মৌসুমে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার দর্শনার্থী পার্কটিতে বেড়াতে আসেন। তবে ইদানীং বন্ধের দিন পাঁচ থেকে সাত হাজার লোকের সমাগম ঘটে। বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে আটঘর থেকে ভীমরুলির খাল। এ ছাড়া শীত মৌসুমে সেখানে পিকনিকের উদ্দেশ্যেও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ যায়।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী জলাবাড়ি ও সমুদয়কাঠি ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের ৬৫৭ হেক্টর জমিতে রয়েছে ২ হাজার ২৫টি সুদৃশ্য পেয়ারাবাগান। ২০০ বছর ধরে গ্রামগুলোয় বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, জিন্দাকাঠি, আদমকাঠি ও ধলহার খালে পেয়ারার মৌসুমে প্রতিদিন ভাসমান হাট বসে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা হাটে পেয়ারা কিনতে আসেন। এ বছর প্রতি হেক্টরে পেয়ারার ফলন হয়েছে গড়ে ১০ টন।
উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রথীন্দ্রনাথ ঘরামি জানান, জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতের বিহার রাজ্যের গয়া থেকে কেউ একজন একটি সুমিষ্ট পেয়ারা এনেছিল। সেই পেয়ারার বীজ বপন করে এ অঞ্চলে পেয়ারা চাষের গোড়াপত্তন ঘটে। গয়া থেকে আনা হয়েছিল বলে স্থানীয় লোকদের কাছে পেয়ারা গৈয়া নামে পরিচিত। আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা চাষ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায়। প্রতি কেজি পেয়ারা পাইকারি মূল্য ১২ থেকে ১৪ টাকা। খুচরা মূল্য ২০ টাকা।
যাতায়াত ও ভাড়া
ঢাকা থেকে নৌ ও সড়কপথে বরিশাল ও ঝালকাঠি যাওয়া যাবে। বরিশাল থেকে সড়কপথে প্রায় ৩০ কিলোমিটার আটঘর কুড়িয়ানা। বরিশাল নগরীর বটতলা থেকে ডিজেলচালিত ‘ম্যাজিক গাড়ি’তে আটঘর কুড়িয়ানা যাওয়া যাবে। জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা। এ ছাড়া ঝালকাঠি থেকে যেকোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেলে ভীমরুলি যাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে নেছারাবাদ উপজেলার স্বরূপকাঠি শহরে যাওয়া যায়। স্বরূপকাঠি থেকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বা মোটরসাইকেলে আটঘর কুড়িয়ানা যাওয়া যাবে। ৭ কিলোমিটার পথ যেতে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
আটঘর কুড়িয়ানা ভাসমান হাট থেকে ট্রলার বা নৌকায় পেয়ারাবাগান দেখতে দেখতে ভীমরুলি যাওয়া যাবে। আবার ভীমরুলি থেকে আটঘর কুড়িয়ানাও যাওয়া যায়।
আটঘর থেকে ভীমরুলি পর্যন্ত আকারভেদে ট্রলারভাড়া পড়বে এক থেকে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া ছোট নৌকায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় আটঘর থেকে ভীমরুলি যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সড়কপথেও পেয়ারার হাট ও বাগানে যাওয়া যায়। তবে দর্শনার্থীরা নৌপথে ঘুরতে বেশি পছন্দ করেন।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে ৩০ বন্ধু পেয়ারাবাগানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওই দলের একজন অনীক হাসান (১৭) বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা পেয়ারাবাগান ও ভাসমান হাটে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তিন হাজার টাকায় একটি ট্রলার ভাড়া করে সারা দিন ঘুরে বেড়িয়েছি।’
আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার জানান, পেয়ারাবাগান ও ভাসমান হাটকে ঘিরে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন। শুক্রবার বন্ধের দিন ১০ থেকে ১২ হাজার পর্যটক আসছেন। তবে এখানে পর্যটকদের থাকার জন্য হোটেল বা মোটেল নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এখানে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্রে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান আটঘর কুড়িয়ানায় পেয়ারাবাগানে পর্যটনকেন্দ্রের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর যোগাযোগ সহজ হওয়ায় পেয়ারাবাগানগুলোয় পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। পর্যটকেরা পদ্মা সেতু দেখার পাশাপাশি বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোয় ঘুরতে আসেন। পেয়ারাবাগানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।