একদিকে শীত, অন্যদিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

শীতের সকালে দলেবলে সাইকেলে করে কাজে যাচ্ছেন দিনমজুরেরা। আজ সকালে রংপুর শহরের বুড়িরহাট সড়কেছবি: মঈনুল ইসলাম

পৌষের শুরুতে রংপুরে শীত জেঁকে বসেছে। সকালে সূর্যের দেখা নেই। তার ওপর ঘন কুয়াশা। ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমন প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই যে যার মতো কাজে নেমে পড়েছেন। গ্রাম থেকে দিনমজুরেরাও কাজের সন্ধানে ছুটে এসেছেন শহরে।

আজ শনিবার সকাল সাতটার দিকে রংপুর শহরের লালবাগ এলাকায় শীতের হিমেল হাওয়ার মধ্যে ভাপা পিঠা বিক্রি করছিলেন আবেদা বেগম নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী। জীবিকার তাগিদে এই বয়সেও শীতের মধ্যে ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি। ভাপা পিঠা খেতে খেতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দুই মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। তারা অন্যত্র থাকে। স্বামী অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। সংসারের খাবার এবং স্বামীর ওষুধের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে লালবাগের এই জায়গাটায় ভাপা পিঠা বিক্রি করেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত তাঁর পাঁচ-ছয় কেজি চালের ভাপা বিক্রি হয়। প্রতিটি ভাপা পিঠা ১০ টাকা।

আবেদা বেগম বলেন, ‘শীতের শুরু থাকি এই পিঠা বিক্রির কাজ করি। যখন যেটা সময় আইসে তখন সেইটা করি। একাই এই কাজ করি আসতেছি। কাজ কাম না করলে খামো কী? ছাওয়া তিনটার বিয়া হইছে। দুইটা মেয়ে, আর একটা ছেলে। তারা আলাদা থাকে। কাজ করিয়া স্বামীক দেখা লাগে। স্বামী পঙ্গু না হইলে এত কষ্ট করা লাগিল না হয়।’

সকাল সাড়ে সাতটায় শহরের পায়রা চত্বর মোড়ে শীতে জবুথবু হয়ে ভ্যানে করে অ্যালোভেরার শরবত বিক্রি করছিলেন মিজানুল ইসলাম (৪০)। প্রাতর্ভ্রমণকারীরা সাধারণত এই শরবত খান। গত সাত বছর ধরে ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এই কাজটি করেন তিনি। তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায়।

মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘শীতের সকালে বাড়ি থেকে বের হতে কষ্ট হয়। কিন্তু উপায় নেই। কাজ করে খেতে হবে। বসে বসে থাকলে সংসার চলবে কেমন করে। তাই প্রতিদিন শীতের সকালেও ছুটে আসা হয়।’ তিনি জানান, সকালে যাঁরা হাঁটতে বের হন, এমন কিছু নিয়মিত ক্রেতা তাঁর আছে। অ্যালোভেরার রস প্রতি গ্লাস ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করেন। প্রতিদিন তাঁর গড়ে বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।

শীতের সকালে গরম ভাপা তৈরি করছেন ফিরোজা বেগম। সামনে অপেক্ষায় শিশুসহ অন্য ক্রেতারা। আজ সকাল সাতটার দিকে রংপুর শহরতলির অভিরাম এলাকায়
ছবি: মঈনুল ইসলাম

সকাল আটটায় তখনো সূর্যের দেখা নেই। শীতের কনকনে হিমেল হাওয়ার মধ্যেও আয়–রোজগারের জন্য পথে নেমেছেন রোকনুজ্জামান নামের এক যুবক। তাঁর বাড়ি গঙ্গাচড়া উপজেলায়। শহরের সুরভি উদ্যানের সামনে ভোর ছয়টা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত মানুষের ওজন ও উচ্চ রক্তচাপ মাপেন তিনি। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তাঁর আয় হয় ৩০০-৪০০ টাকার মতো। শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মচারী হয়েও সাতসকালে এই সেবামূলক কাজটি করে আসছেন তিনি।

রোকনুজ্জামান বলেন, ‘স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। চাকরির সামান্য টাকায় সংসার চলে না। তাই বাড়তি আয়ের জন্য প্রতিদিন সকালে সুরভি উদ্যানের সামনে দুটি যন্ত্র নিয়ে বসি। এতে কিছু আয় হয়। তবে গত কয়েক দিন থেকে ঘন কুয়াশায় খুব কষ্ট হচ্ছে। এরপরও ছুটে আসছি। প্রাতর্ভ্রমণকারীদের সেবা দিয়ে বিনিময়ে যে যা দেয়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকি।’

শীতের সকালে কাজের অপেক্ষায় দিনমজুরেরা। রংপুর নগরের শিমুলবাগ এলাকায়
ছবি: মঈনুল ইসলাম

পৌষের শুরুতেই শীতে মানুষজন কাহিল হয়ে পড়েছেন। তার ওপর উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে। তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকা গঙ্গাচড়া উপজেলার দিনমজুরেরা কাকডাকা ভোরে ছুটে আসেন শহরের শিমুলবাগ এলাকায়। সেখানে শ্রম বিক্রির জন্য দল বেঁধে বসে থাকেন তাঁরা। কখনো কাজ জোটে, আবার কখনো জোটে না। তাঁরা বিভিন্ন বাসাবাড়ির নির্মাণসামগ্রী, বালু ও ইট এক স্থান অন্য স্থানে নেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন।

সকাল সাড়ে আটটার দিকে শিমুলবাগ এলাকায় কাজের সন্ধানে আসা ২০ থেকে ২৫ জন দিনমজুরের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের সবার সঙ্গে একটি করে বাইসাইকেল। আজিজুল ইসলাম (৪৫) নামের একজন দিনমজুর বলেন, ভোরবেলা বাড়ি থেকে গরম ভাত খেয়ে ১৬ কিলোমিটার দূরের পথ থেকে এখানে ছুটে এসেছেন কাজের সন্ধানে। এটি তাদের প্রতিদিনের চিত্র। শীতের সকালে বাড়ি থেকে বের হতে খুব কষ্ট হলেও আসতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মতো আরও অনেকেই এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও শহরে ছুটে এসেছেন শুধু জীবিকার তাড়নায়।