‘স্কুলে আসার পর স্যাররা বলল আজ পরীক্ষা হবে না’

শিক্ষার্থীরা এসেছিল বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু বিদ্যালয়ে এসেই জানতে পারে শিক্ষকদের আন্দোলনে পরীক্ষা হচ্ছে না। তাই সহপাঠীদের সঙ্গে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আড্ডায় মেতেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার সকালে কুমিল্লা নগরের নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লা নগরের নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার (রাহি)। আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে বিদ্যালয়ে এসেছে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় বসার জন্য। তাদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। সাড়ে ৯টা থেকে পরীক্ষা শুরুর কথা। কিন্তু বিদ্যালয় আসার পর সাবেকুন নাহার জানতে পারে, আজ তাদের পরীক্ষা হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকেরা তাঁদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতিতে আছেন।

হতাশ হয়ে বাসায় ফেরার সময় সাবেকুন নাহার প্রথম আলোকে বলে, ‘রাতে পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। সকালে ঘুম থেকে ওঠেও পড়াশোনা করেছি। কিন্তু স্কুলে আসার পর স্যাররা বলল আজ পরীক্ষা হবে না। তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছি।’

আজ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির কারণে এমন বিড়ম্বনায় পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর অসংখ্য শিক্ষার্থী।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রবেশ পদ সহকারী শিক্ষক পদটি বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করাসহ চার দফা দাবিতে আজ থেকে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন শিক্ষকেরা। কর্মবিরতির অংশ হিসেবে তাঁরা চলমান বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রেখেছেন। গত ২৪ নভেম্বর থেকে এ বছরের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার ‘বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির’ ব্যানারে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের চারটি দাবি হলো সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক‍্যাডারভুক্ত করে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’-এর গেজেট প্রকাশ; বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা; সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া এবং ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের দুই থেকে তিনটি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন-সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ।

কুমিল্লা জিলা স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার আর শিক্ষকদের সংখ্যা ৫৩। আজ বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লা জিলা স্কুলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সহকারী শিক্ষকেরা দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে। তবে বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি চোখে পড়েনি।

চার দফা দাবিতে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন কুমিল্লা জিলা স্কুলের সহকারী শিক্ষকেরা। রোববার সকালে স্কুলের প্রশাসনিক ভবনের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষকেরা বলেন, আজ সকালে ৮ম ও ১০ম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ছিল। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাঁদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছেন। এ জন্য শিক্ষার্থীরা বাসায় ফিরে গেছে। বিকেলের শিফটে ৭ম ও ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সেটিও হচ্ছে না।

কুমিল্লা জিলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো দাবির জন্য আন্দোলন করছি না, আমরা আন্দোলন করছি আমাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য। অনেকে বলছেন, আমাদের আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা তো আমাদেরই সন্তান। সরকার যদি আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়, তাহলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। আমরা ছুটির দিনেও কাজ করে ডিসেম্বরের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করবে, কিন্তু দাবি পূরণ না হলে কর্মবিরতি চলবে।’

নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৮১। এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৫১। আজ সকাল ৯টার দিকে নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের অফিসকক্ষে অলস সময় পার করতে দেখা গেছে। বিদ্যালয় আঙিনায় দলে দলে এসেছে পরীক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসে জেনেছে আজ পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের তাদের সহপাঠীর সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে।

ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহেরীন আক্তার প্রথম আলোকে বলে, ‘বার্ষিক পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম। বিদ্যালয়ে আসার পরে স্যাররা বললেন, তাঁদের আন্দোলনের কারণে আজ পরীক্ষা হবে না। কাল বা পরশু দিন পরীক্ষা হবে কি না, সেটাও এখনো নিশ্চিত না। স্যাররা বলেছেন, কবে পরীক্ষা হবে, সেটা পরবর্তী সময়ে জানাবে। তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছি।’

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক কামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ৯ম গ্রেড দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ১৯৭৭ সালে আমরা ১০ম গ্রেডে ছিলাম, এখনো আমরা একই গ্রেডে আছি। পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, সাব–রেজিস্ট্রারসহ সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান হলেও আমাদের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য করে রাখা হয়েছে। আমরা এই বৈষম্যের অবসান চাই। সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই আমাদের দাবিগুলো যেন দ্রুত মেনে নেওয়া হয়। আমরাও ক্লাসে ফিরতে চাই।’

একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি বার্ষিক পরীক্ষার সময় শিক্ষকদের এমন আন্দোলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীদেরকে জিম্মি করে এখন দাবি আদায় করছেন শিক্ষকেরা। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নতুন বছরে তারা এই কর্মসূচি পালন করতে পারতেন। হঠাৎ এমন আন্দোলনের প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মধ্যে।