নির্বাচন ঘিরে নাবিল ও শাহিনের দ্বন্দ্ব তীব্রতর

যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। এই নির্বাচনে তাঁরা দুজন চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন।

তৃতীয় ধাপে ২৯ মে যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে। এখানে চেয়ারম্যান পদে ছয়জন প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম (জুয়েল) ও জেলা যুব মহিলা লীগের নেত্রী ফাতেমা আনোয়ার ও তৌহিদ চাকলাদার।

কাজী নাবিল আহমেদ যেভাবে বসাবসি করে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, সেটা ঠিক হয়নি
শাহীন চাকলাদার

এঁদের মধ্যে তৌহিদ চাকলাদার যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই। শাহীন চাকলাদারের বিরোধীপক্ষের ভাষ্য, যশোর শহরে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে শাহীন চাকলাদার তাঁর দীর্ঘদিনের অনুসারী নেতাদের প্রার্থী না করে নিজের চাচাতো ভাইকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেছেন। এদিকে কাজী নাবিল আহমেদ বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে (বিপুল) সমর্থন দিয়েছেন।

এ বিষয়ে শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে এমন কোনো নির্দেশনা নেই যে কারও পক্ষে নির্বাচন করা যাবে না। আমি তৌহিদ চাকলাদারের পক্ষে ভোট করছি। মূল কথা হচ্ছে, ভোটের মাঠে ভোটার ওঠাতে হবে। যে প্রার্থী সেটা করতে পারবেন, সেই বিজয়ী হবেন। সদর উপজেলার রাজনীতি দুর্বল হয়ে গেছে বলে আবার আমাকে মাঠে নামতে হচ্ছে।’

শাহীন চাকলাদার অভিযোগ করেন, ‘কাজী নাবিল আহমেদ যেভাবে বসাবসি করে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, সেটা ঠিক হয়নি।’

এ বিষয়ে জানার জন্য কাজী নাবিল আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

তবে এ বিষয়ে কাজী নাবিল আহমেদ সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যশোর আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটো ধারায় বিভক্ত, এটা সবাই জানেন। আমি কাজী নাবিলের সঙ্গে রাজনীতি করি। কাজী নাবিল আমাকে স্নেহ করেন। এ জন্য সবাই বলছেন, আমি কাজী নাবিলের প্রার্থী। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতারা বসে আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ দুই নেতার প্রকাশ্যে প্রার্থীদের সমর্থনের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অন্য প্রার্থীরা। কাজী নাবিলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত যশোর জেলা যুবলীগের সভাপতি চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘দলের সর্বোচ্চ ফোরামে সিদ্ধান্ত হলো মন্ত্রী এমপি ও দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারবেন না। সদরের এমপি কাজী নাবিল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ওই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পছন্দের দুই প্রার্থী ঘোষণা করলেন। তৃণমূলে কোন্দল সৃষ্টি করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁরা দুজনই প্রার্থী দিয়েছেন। দলের কাছে তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে।’

একইভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ। তিনি বলেন, ‘সদর উপজেলায় শাহীন চাকলাদার তাঁর চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদারকে একক প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা হয়ে তিনি এমনটি করতে পারেন না। মূলত তিনি তাঁর ভাইকে প্রার্থী করতে চান আবারও সদরের রাজনীতিতে একক আধিপত্য বিস্তার করতে। এতে দলের তৃণমূলে কোন্দল সৃষ্টি হবে।’

প্রার্থীদের মধ্যে মোস্তফা ফরিদ আহমেদ ও ফাতেমা আনোয়ার কাজী নাবিলের আনুসারী এবং মোহিত নাথ ও শফিকুল ইসলাম শাহীন চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে রাজনীতির মাঠে এত দিন সরব ছিলেন। মোহিত নাথ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজী নাবিল আহমেদে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়ে এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এই চারজনই তাঁদের পছন্দের কয়েকজন নেতা-কর্মী নিয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন। ফলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিল আহমেদের ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ তৈরি হয়েছে।

যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কাজী নাবিল ও শাহীন চাকলাদারের মধ্যে বিরোধ প্রায় এক দশকের। মূলত যশোর-৩ (সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন ও আধিপত্য ঘিরেই তাঁদের দুজনের এই দ্বন্দ্ব। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে তাঁরা দুজন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কাজী নাবিল। তখন মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন শাহীনের সমর্থকেরা।

এরপর ২০১৮ সালে আবারও মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন শাহীন চাকলাদার। আবারও মনোনয়ন পান কাজী নাবিল। এতে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। ২০২০ সালে কেশবপুরের সংসদ সদস্য ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। ওই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে শাহীন চাকলাদার নির্বাচিত হন। এরপর সদর উপজেলায় তাঁর একক আধিপত্যে ভাটা পড়তে থাকে। গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কেশবপুরে দলীয় মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান শাহীন চাকলাদার।

কেশবপুরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত তিন বছর সদরের রাজনীতিতে আধিপত্যে ভাটা পড়ে শাহীন চাকলাদারের। আর টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে নিজের শক্ত ভিত গড়েছেন কাজী নাবিল।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, শাহীন চাকলাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সদর উপজেলার টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। আবারও সদরের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আর কাজী নাবিল নিজের দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখতে চাইছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুজনের সেই দ্বন্দ্বই ফুঠে উঠছে।