৩ বছরে পানিতে ডুবে ২৩৯ শিশুর মৃত্যু

পানিতে ডুবে মৃত্যুপ্রতীকী ছবি

দুই বছরের শিশু আদনানকে বাড়ির উঠানে খেলায় বসিয়ে রেখে তার মা সাবিনা খাতুন রান্নাঘরে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করছিলেন। শিশুটির বাবা সোহাগ মিয়া ছিলেন বোরো খেতে। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আদনানকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। একপর্যায়ে বাড়ির সামনের পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুটির ভাসমান মরদেহ। গত বুধবার নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের দিগর সহিলহাটি গ্রামে ঘটনাটি ঘটে।

গত বছরের ১১ জুলাই নেত্রকোনার মদনের মাঘান ইউনিয়নের রামদাসখিলা গ্রামে চার বছরের শিশু হাসাইন ও দুই বছরের তাসলিমাকে দুপুরের খাবার দিয়ে তাদের বাবা শফিকুল ইসলাম ও মা খোদেজা বাড়ির সামনে গোয়ালঘরে গরুকে খাবার দিতে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দুই সন্তানকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বাড়ির পেছনে নদী থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করেন।

শুধু আদনান, হাসাইন ও তাসলিমাই নয়, নেত্রকোনায় পানিতে ডুবে গত ৩ বছর ২ মাসে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত অন্তত ২৩৯ শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু গত জুলাই ও আগস্টে অন্তত ২১ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের বয়স ১৮ মাস থেকে ১১ বছরের মধ্যে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রথম আলোর সংবাদ, হাসপাতাল ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা হিসাব বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নেত্রকোনা সিভিল সার্জন সেলিম মিঞা এ বিষয়ে জানান, জেলায় বর্ষাকালে পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। শিশুদের সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞান না থাকা, সচেতনতার অভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঘটনা বেশি ঘটছে। এ বিষয়ে নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘পানিতে ডুবে এত শিশুর মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। কমিউনিটি সচেতনতা ছাড়া কোনো পথ নেই। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর পুলিশ সেখানে যায় এবং সচেতনতা বাড়াতে তারা এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে।’

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের জুন, আগস্ট ও মে মাসে জেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ওই ৩ মাসে ৪১ শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু মে মাসেই কলমাকান্দা উপজেলায় ৯ শিশুসহ ১৯ শিশু মারা যায়। আর জুনে ১১, জুলাইয়ে ১৩ ও মে মাসে ৯ শিশুর মৃত্যু হয়। উপজেলাভিত্তিক হিসাবে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, কেন্দুয়া ও পূর্বধলায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। গত ১ বছরে কলমাকান্দায় ২৯ শিশু, দুর্গাপুরে ১৮, কেন্দুয়ায় ১৫ ও পূর্বধলায় ১৫ শিশুর মৃত্যু হয়।

কলমাকান্দার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই বেশির ভাগ সময় শিশুদের মৃত্যু হয়ে যায়। কেউ ডুবে গেলে তাকে উদ্ধারের পরপর তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার যেসব প্রাথমিক উদ্যোগ আছে, সেগুলো বিভিন্ন সভা–সেমিনারে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে লোকজনদের শেখানো হচ্ছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, তাদের বয়স দেড় থেকে ১১ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগ শিশুই বাড়ির সামনে, পেছনে বা পাশের গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, পুকুর, ডোবা (ছোট জলাশয়) বা নদীতে ডুবে মারা গেছে। এসব মৃত্যুর ঘটনা সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বেশি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরের লোকজন কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিশুরা কোথায় খেলছে, অনেক সময় তাঁরা খেয়াল করেন না। আর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়ে যখন পরিবারের সদস্যরা বিশ্রাম করেন, তখন শিশুরা খেলতে বের হয় আর দুর্ঘটনার শিকার হয়। মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিশু বেশি।

জেলায় গত ৩ বছরে ২৩৯ শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেলা নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ এমরান বলেন, কমিউনিটি সচেতনতা ছাড়া কোনো পথ নেই। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ ও প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন। জেলায় সাঁতার শেখারও কোনো ব্যবস্থা নেই।

এ বিষয়ে গণসচেতনা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ।