মুক্তির যুদ্ধ—২
রাধানগরে ৩৬ ঘণ্টার লড়াই, পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল মার্চে। এরপর ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধে রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ডিসেম্বরে আসে বিজয়। প্রতিরোধের সেই লড়াই নিয়ে এ আয়োজন।
সিলেট-তামাবিল সড়কটি ভৌগোলিক কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তামাবিলের ওপাশে ভারতের ডাউকি-শিলং সড়ক। এপাশে বাংলাদেশ অংশের সড়ক ধরে সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব হয়ে ঢাকা পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তাই সড়কটি দখলের পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ভারতীয় সেনা আসার পথ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ঠেকাতে পাকিস্তানি বাহিনী সড়কের পাশের রাধানগর গ্রামে ক্যাম্প বসায়।
রাধানগর গ্রামের অবস্থান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এক হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনার অবস্থান ছিল ওই ক্যাম্পে। এখানে সিলেট শহরে থাকা সেনাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের গ্রামে অত্যাচার-নিপীড়ন, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়।
তবে প্রায় এক মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর মধ্যরাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর ক্যাম্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। সেই যুদ্ধের কথা লেখা আছে দিব্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত লে. কর্নেল (অব.) এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রমের অপারেশন রাধানগর বইয়ে। তিনি ছাড়াও মেজর শাফায়াত জামিলসহ কয়েকজন এ লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন।
নূরুন্নবী খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘দখলদার বাহিনী পুরো রাধানগর এলাকাটিকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে ফেলে। রাধানগরে তাদের অবস্থান সুসংহত করার পাশাপাশি উক্ত এলাকার লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, শিমুলতলা, ছাত্তার গাঁ, ভিত্রিখেল, বাউরবাগ, বাউরবাগ হাওর, হোঁয়াওয়া গ্রামসহ এক বিস্তৃত এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এসব এলাকায় বর্বর বাহিনী ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ নানাবিধ বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে।’
পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার বিষয়টি প্রভাবকের মতো কাজ করেছে। এ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। যুদ্ধ করে একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করেছেন।হাসান মোরশেদ, গবেষক
মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা তাই পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর ক্যাম্প পুরোপুরি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান শুরু করেন। তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে অবরুদ্ধ করেন। পালিয়ে যাওয়ার পথ হিসেবে দক্ষিণে গোয়াইনঘাটের অংশটি শুধু খোলা রাখেন।
উভয় পক্ষে আক্রমণ–পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। ২৬ নভেম্বর ভারতীয় গুর্খা বাহিনীর একটি রেজিমেন্ট রাধানগর ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। তবে সফল হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ৫) বইয়ে বলা হয়েছে, ৭১ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন। এতে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের মনোবল বিপর্যস্ত হয়। পরে অবশ্য ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আবার আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। এমন আক্রমণের শুরুতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি নুরুল হক (বীর উত্তম) শহীদ হন।
ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত গবেষক হাসান মোরশেদের ঈশানে নিশান: মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক উপাখ্যান বইয়ে সে যুদ্ধের কথা আছে। যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার সূত্রে তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য রেকর্ড করেছিলেন। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের সাহায্য ছাড়া টানা ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যার পর আশপাশের কিছু এলাকার দখল নেন তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের আওতাধীন মুক্তিযোদ্ধারা।
রাধানগর শত্রুমুক্ত হয়ে যাচ্ছে—এ খবর দ্রুত আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশে থাকা কমান্ডাররা দলবল নিয়ে রাধানগর এলাকায় পাকিস্তানিদের অবস্থান লক্ষ্য করে আক্রমণ চালান। রাত ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া আক্রমণ করেও টিকতে না পেরে পিছু হটে। রাত ১২টার দিকে তারা গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের দিকে চলে যায়।
মুক্তিযোদ্ধারা এমন বিজয়ে উল্লাস শুরু করেন। পরদিন ৩০ নভেম্বর সকালে বিজয়ী কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে রাধানগর এলাকায় এসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চারপাশ মুখরিত করে তোলেন।
রাধানগরে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার বিষয়টি সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন হাসান মোরশেদ। তাঁর কথা, পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার বিষয়টি প্রভাবকের মতো কাজ করেছে। এ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। যুদ্ধ করে একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করেছেন।