স্ত্রীকে হালুয়া-রুটি বানাতে বলে বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে

অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আনোয়ার হোসেনের লাশ গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। সোমবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বড়াইগ্রাম গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র শবে বরাতের দিন স্ত্রীকে হালুয়া-রুটি বানাতে বলে বন্ধু ওলিউল্লাহ ওরফে অলি বকসের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন (৪২)। তাঁর স্ত্রী হালুয়া-রুটি বানিয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার জন্য অপেক্ষাও করেছিলেন। কিন্তু আনোয়ার আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। ছয় দিন পর আজ সোমবার সকালে বাড়িতে ফিরলেন কফিনবন্দী লাশ হয়ে।

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার খোকসা গ্রামে গত মঙ্গলবার রাতে আনোয়ার হোসেন তাঁর বন্ধু ওলিউল্লাহর বাড়িতে থাকাকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ওলিউল্লাহর স্ত্রী সোমা আক্তার (২৮), মেয়ে অমিয়া খাতুন (৯) ও ছেলে ওমর আলী (৩)। আগুন নেভাতে গিয়ে আনোয়ার ও ওলিউল্লাহ গুরুতর দগ্ধ হন। ওই দিনই আনোয়ারকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রোববার রাতে তিনি মারা যান। আজ সকালে তাঁর লাশ কফিনবন্দী অবস্থায় বড়াইগ্রামের নিজ বাড়িতে আনা হয়েছে।
আনোয়ারের লাশ বাড়িতে আনার সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। গ্রামের মানুষ ভিড় করেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া চতুর্থ ব্যক্তির লাশ দেখতে।

আনোয়ারের বাবা মারা গেছেন অনেক দিন আগেই। মা জহুরা বেগম অভাব–অনটনে বড় করেছেন আনোয়ারকে। লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। তিনি স্থানীয় মৌখড়া বাজারে কুলির কাজ করে সংসার চালাতেন। সংসারে আছে স্ত্রী মুর্শিদা বেগম, ছেলে মো. আবদুল্লাহ (১৫), বায়দুল্লাহ (৯) ও সাবাবুল্লাহ (৮)। নিজে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও আনোয়ার তাঁর তিন ছেলেকে শিক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বড় ছেলে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় এবং অপর দুই ছেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বসতভিটা ছাড়া তাঁদের কোনো জমি নেই। এ অবস্থায় সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন জহুরা বেগম ও মুর্শিদা বেগম।

বাপহারা ছেলেটারে কত কষ্ট করে মানুষ করিছিনু। লেখাপড়া করাতে পারিনি। কিন্তু গায়ে খাটি সংসার চালাত। একন আমরা কার ভরসায় বাঁচপো?
জহুরা বেগম, আনোয়ারের মা

মুর্শিদা বেগম বলেন, ‘শবে বরাতের দিন সকালে আবদুল্লাহর বাপ হালুয়া-রুটি খাতে চাইল। বাড়িতে চাল-আটা ছিল না। সে বাজার থেকে চাল-আটা এনে দিয়ে বলল, দুপুরে বাড়িতে হালুয়া-রুটি খাব। কিন্তু সে আর বাড়িতে ফিরল না। রাত ১০টার দিকে শুনি বন্ধু অলি বকসের বাড়িতে আগুন নেভাতে গিয়ে সে পুড়ে গেছে। এত দিন চিকিৎসা চলছিল। ভাবিছিনু সে ভালো হয়ে বাড়িতে এলে হালুয়া-রুটি বানায়ে দিব। কিন্তু ওর বরাতে আর হালুয়া-রুটি খাওয়া হলো না। এখন আমি তিন ছেলেকে নিয়ে কী করব?’

মা জহুরা বেগম বলেন, ‘বাপহারা ছেলেটারে কত কষ্ট করে মানুষ করিছিনু। লেখাপড়া করাতে পারিনি। কিন্তু গায়ে খাটি সংসার চালাত। একন আমরা কার ভরসায় বাঁচপো?’

আজ সকালে বড়াইগ্রাম গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধ ওলিউল্লাহ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে এসেছেন। তাঁর কপাল ও হাতে এখনো ঘা দগদগ করছে। গামছা দিয়ে সেই ঘা ঢেকে বন্ধুর বাড়িতে এসেছেন খাটিয়ায় শুয়ে থাকা বন্ধুর লাশ দেখতে। বাক্‌রুদ্ধ ওলিউল্লাহর দুই চোখ বেয়ে শুধুই পানি ঝরছে।

অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আনোয়ার হোসেনের লাশ বাড়িতে আনা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা। সোমবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বড়াইগ্রাম গ্রামে
ছবি: মুক্তার হোসেন

ওলিউল্লাহর ভাই আবদুস সামাদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে অলি বকস ও আনোয়ারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। অলি বাস চালাত। বাড়িতে এলে বেশির ভাগ সময় আনোয়ারের সঙ্গে কাটাত। তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টার পরও চিকিৎসকেরা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি।’

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সিদ্দিক জানান, পরিবারের অনুরোধে আনোয়ারের লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।