ছাত্রলীগের কর্মীদের বকেয়া পরিশোধের তাগিদ ক্যানটিনমালিকের

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ক্যান্টিনে গত পাঁচ-ছয় মাসে এক লাখ টাকার বেশি বাকি পড়েছে। এ বকেয়া পরিশোধে নোটিশ টাঙিয়েছেন ক্যান্টিনমালিক শফিকুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থীদের বাকিতে খেতে দিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ক্যানটিনমালিক মো. শফিকুল ইসলাম। গত পাঁচ-ছয় মাসে শিক্ষার্থীরা ওই ক্যানটিনে খাবার খেয়ে এক লাখ টাকার বেশি বকেয়া করেছেন। এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

শফিকুল ইসলাম ক্যাম্পাসে শফি ভাই নামে পরিচিত। সোমবার আক্ষেপ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের অনেকবার বলেছি, আমার অনেক ঋণ আছে। ঋণ শোধ করতে পারলে শান্তি পাব। বকেয়ার টাকাটা দাও। এই গরিবের দিকে তাকাও। আমি তোমাদের সেবক। আমার বুকে লাথি মেরো না। তোমরা যদি আমাকে ভাত না দাও, তাহলে গুলি করে মেরে ফেলো।’

২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ক্যানটিন পরিচালনার দায়িত্ব পান শফিকুল ইসলাম। তখন থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকা বাকিতে খেয়ে আর পরিশোধ করেননি বলে দাবি করেন তিনি। বাকিতে খাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী অভিযোগ করে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানকার ছাত্রলীগেরই ছেলেরা বাকি খেয়েছে। নন–পলিটিক্যাল ছেলে অল্প কয়েকটা হতে পারে। এখন আর পারছি না। তোমাদের কত টাকা বাকি দিতে হবে বলো। দেব আমি। কিন্তু তোমরা নিজেদের মতো করে বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ করছ না কেন, এটাই আমার কষ্ট।’

শফিকুল ইসলাম লেখাপড়া জানেন না। তাই কে কত টাকা বাকিতে খেয়েছেন, সেটা বলতে পারেন না। তবে বাকি লিখে রাখার জন্য তাঁর খাতা রয়েছে। তাতে কে কত টাকা বাকিতে খেয়েছেন, তা শিক্ষার্থীরাই লিখে রাখেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দিয়ে তাঁর তিনটি খাতা পড়িয়েছেন। এতে গত পাঁচ-ছয় মাসে বাকি পেয়েছেন এক লাখ টাকার বেশি।

শফিকুল ইসলাম বলেন, অনেক দিন ধরে টাকা চেয়েও পাচ্ছেন না। পরে রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁদের পরামর্শে তিনি ক্যানটিনের কয়েক জায়গায় বাকি পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন।

নোটিশে লেখা রয়েছে, ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। আমার চলতে কষ্ট হয়, আমাকে ক্যানটিন চালাতে সহযোগিতা করুন। বি.দ্র. বাকির খাতা পরিশোধ করুন। অনুরোধে, শফি ভাই।’

অনেকগুলো বাকির খাতা পুড়িয়ে ফেলেছেন দাবি করে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রুনু ভাইও (ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি) বলছেন, “শফি ভাই, আপনার তো ম্যালা লাখ টাকা শেষ করে দিয়েছে।” তো বললাম, “ওসব চলে গেছে। খাতা পুড়িয়ে ফেলেছি। এখন যেটা আছে, সেটার জন্য যদি একটু তদবির করেন, যা–ই উঠুক। ২০ হাজার, ২৫ হাজার উঠুক। তবু তো কিছু পেয়ে চালাতে পারব।” বর্তমান সময়ে জিনিসের অনেক দাম। আর পারছি না।’

শফিকুল ইসলাম কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা থেকে ১৯৭১ সালে মা–বাবার সঙ্গে রাজশাহীতে আসেন। বর্তমানে নগরের বিনোদপুর এলাকার মির্জাপুরে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ছোটবেলা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বড় হয়েছেন।

ক্যান্টিনমালিক শফিকুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

তিন বেলা ক্যানটিন চালাতে পাঁচ থেকে ছয়জন কর্মচারী রয়েছে। তাঁদের প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার টাকা পারিশ্রমিক দিতে হয়। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেরা ক্যানটিনে সময় দেন। ক্যানটিন চালিয়েই তাঁর সংসার চলে। বিষাদজড়িত কণ্ঠে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে। বর্তমানে জিনিসপত্রের প্রচুর দাম। তবু ক্যানটিনে কোনো খাবারের দাম বাড়াইনি। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চাই। এমন যেন না হয় যে আমাকে শেষ করে দিয়ে বাঁচবে। তোমরা শিক্ষিত ছেলে, তোমাদের কাছে কি আমি ভাত পাব না? আমি বাঁচতে চাই। আমার বউ ছেলেপেলে আছে।’

এ বিষয়ে কথা হয় হলটির প্রাধ্যক্ষ সাইখুল ইসলাম ওরফে মামুন জিয়াদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানটিনের বিষয়টি একান্তই তাঁর। তিনি কীভাবে ব্যবসা করবেন, বাকি দেবেন কি দেবেন না, এটা তাঁর দায়দায়িত্ব। এখানে হল প্রশাসন কোনো ভর্তুকি দেয় না। তাই কোনো হস্তক্ষেপও করে না।

সোমবার বেলা ১১টার দিকে ওই ক্যানটিনে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কাজ করছিলেন শফিকুল ইসলাম। বাইরে বেঞ্চে বসে কয়েকজন খাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রী গেছেন বিনোদপুরে। কিছুক্ষণ পর তিনি ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে এসে তরকারি কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে ক্যাশ টেবিলের সামনে শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। অনুরোধ করে বলেন, ‘সত্যিই ভাই, খুব বিপদে আছি। যদি কিছু টাকা তুলে দেন।’

সেখানে বসে খাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, যাঁরা এখানে দলীয় পরিচয় ভাঙিয়ে বা সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে বাকি খাচ্ছেন, তাঁরা কাজটা ঠিক করছেন না। শফি ভাইকে আমরা চিনি। তিনি অনেক ছাত্রকে বলেন, ‘‘ভাই, তুমি খাও। টাকা পরে দিয়ো।’’ কিন্তু মানুষগুলো তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেছে।’

এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ ওরফে রুনুর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শফি ভাই তাঁদের কাছে এসেছিলেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, যেসব শিক্ষার্থী তাঁর কাছ থেকে বাকি খেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন। টাকা পরিশোধ করার ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। তিনিই তাঁকে নোটিশ ঝোলানোর পরামর্শ দিয়েছেন।