চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না রায়হানের
সবজি বিক্রি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়াশোনা করেছে মো. রায়হান (১৬)। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় তার বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। স্বপ্ন দেখত চিকিৎসক হওয়ার। ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। সেই জ্বরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে তার। ঠিকমতো চিকিৎসাসেবাও পায়নি রায়হান। রায়হানদের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ছোট ডালিমা গ্রামে।
রায়হানের শিক্ষক ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিল রায়হান। বসতঘর ও ভিটে ছাড়া কিছুই নেই তাদের। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রায়হান ছিল মেজ। বড় বোন মোছা. লামিয়ার (২২) বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন মোছা. ছামিয়ার বয়স মাত্র ছয় বছর। ২০১৯ সালে রায়হানের বাবা আবদুর রব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। পরে তিনি মারা যান। শিশু রায়হান তখন উপজেলার আবদুস ছালাম মৃধা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। শিশু হলেও সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। সবজি বিক্রি করে সংসার চালাত। পাশাপাশি পড়াশোনা করত। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় শিক্ষকদের আলাদা নজর ছিল রায়হানের ওপর। কোনো বেতন দিতে হতো না।
আবদুস ছালাম মৃধা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ৪০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ৩০ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়। এর মধ্যে রায়হান শুধু জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাঁচ-ছয় দিন আগে হঠাৎ তার জ্বর অনুভব হয়। একটি দাঁতের গোড়ালিতে রক্তের জমাট বাঁধে। স্থানীয়ভাবে পল্লিচিকিৎসের ওষুধও খেয়েছে। তাতে ভালো হয়নি। এক শিক্ষকের পরামর্শে গত মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. মিরাজকে দেখায়। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি রক্তের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। ধারদেনা করে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান মা মোছা. জেসমিন বেগম (৩৮)। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের পরীক্ষা করানোর জন্য নমুনা দিয়ে এক স্বজনের বাসায় যান। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে রায়হান মারা যায়।
রায়হানের মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। রায়হানের স্বজন মো. আনিচুর রহমান গোলদার বলেন, রায়হান যে বয়সে ওর বাবাকে হারিয়েছে, তাতে ওর পড়াশোনা করার কথা নয়, বখাটে হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে কখনো বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশত না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, স্কুলে যেত ও সবজি বিক্রি করে সংসার চালাত। হতে চেয়েছিল চিকিৎসক। কিন্তু ওর অকালমৃত্যুতে শুধু চিকিৎসক হওয়ার সেই স্বপ্নই শেষ হয়ে যায়নি, শেষ হয়ে গেছে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রায়হান ভালো ছাত্র ছিল। তার আচার-ব্যবহারও ভালো ছিল। রায়হানের শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রায়হান ছিল অত্যন্ত বিনয়ী, মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র। ওকে পরামর্শ দেওয়ার মতো পরিবারে কেউ ছিল না। এরপরও সে স্বপ্ন দেখত চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা জেসমিন বেগম দিশাহারা। বিলাপ করছিলেন, আর বলছিলেন, ‘রক্তের পরীক্ষার রিপোর্ট পাইলাম না, হেইয়ার আগেই কলিজার টুকরা মারা গেল। আমি কারে নিয়ে বাঁচব? আমার সংসার চলবে ক্যামনে?’