অবশ শরীর নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন হাসেম
পরীক্ষার কক্ষে সবাই বেঞ্চে বসে একমনে প্রশ্নের উত্তর লিখে যাচ্ছেন খাতায়। তাঁদের পাশে পরীক্ষার কক্ষের বারান্দায় বসে লিখছেন আরেক শিক্ষার্থী আবু হাসেম (২০)। তাঁকে দেওয়া হয়েছে টেবিল ও চেয়ার। সামনে চলছে বৈদ্যুতিক পাখা। আর সেখানে বসেই মনোযোগ দিয়ে লিখে যাচ্ছেন তিনি।
একনজরে দেখলে হাসেমকে স্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেরুদণ্ডের হাড়ে গুরুতর রোগাক্রান্ত হয়ে হাসেমের কোমর থেকে দুই পায়ের পুরোটাই অবশ হয়ে গেছে। একা হাঁটতে পারেন না। দাঁড়ালেই দুই পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু প্রতিবন্ধিতা তাঁকে দমাতে পারেনি।
শেরপুর সরকারি কলেজ কেন্দ্রের একটি কক্ষের বারান্দায় বসে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সরকারি আদর্শ কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া এ পরীক্ষায় অংশ নেন হাসেম।
আবু হাসেম শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রাজনগর গ্রামের দিনমজুর উসমান গনি ও গৃহিণী মাহমুদা বেগমের ছেলে। তাঁর দুটি পা অবশ। চলাফেরায় স্বজনদের সহযোগিতা নিতে হয়। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ আর মনের জোরে কারও সহযোগিতা ছাড়াই পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি। ২০২১ সালে ঝিনাইগাতী উপজেলার মালিঝিকান্দা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৪ দশমিক শূন্য ৬ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।
পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হাসেমের বাবা উসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে প্রথমে হাসেমের পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। এরপর আকস্মিকভাবে কোমর থেকে তাঁর দুই পা অবশ হয়ে যায়। পরে শেরপুর জেলা সদর হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ঢাকায় তাঁর মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারও করা হয়। এরপরও হাসেম সুস্থ হয়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সম্ভব হয়নি। শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে কেউ যেন তাঁকে সমাজের বোঝা না মনে করেন, সে জন্য তাঁকে পড়ালেখা করাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরীক্ষার কক্ষের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে ও টেবিলের ওপর খাতা রেখে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিচ্ছেন হাসেম। শারীরিকভাবে অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী হওয়ায় বড় বোন রুখসানাকে তাঁর পাশে অবস্থানের অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষা শেষে বাবা উসমান গনির পিঠে চড়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসেন হাসেম।
বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা শেষে কথা হয় আবু হাসেমের সঙ্গে। জানতে চাইলে আবু হাসেম বলেন, ভালো ফলের আশা তাঁর। ভালো কোনো কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা হতে চান। তিনি বলেন, শারীরিক সমস্যার জন্য একা চলাফেরা করতে পারেন না। তাই চলাফেরা করার জন্য তাঁকে একটি হুইল চেয়ার ও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সরকারসহ সমাজের বিত্তবান মানুষের কাছে আবেদন করেন।
শেরপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সমাজে অনেক ভালো ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা বাদ দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। অথচ শারীরিক প্রতিবন্ধিতা সত্ত্বেও অদম্য মেধাবী হাসেম পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের শিক্ষার্থীদের আরও সহযোগিতা করা হলে ভবিষ্যতে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন।