ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ঘনিয়ে এলেও নাটোরের দুটি আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির টানাপোড়েন থামেনি। কোনো আসনে সভা-সমাবেশ করে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। কোনো আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে আছেন। বাকি আসনগুলোতে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ নেতা–কর্মীরা।
চারটি সংসদীয় আসন নিয়ে নাটোর জেলা। বিএনপি দুই ধাপে চারটি আসনেই দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। জামায়াত সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে অনেক আগেই। এনসিপিসহ কয়েকটি দলও সম্প্রতি একাধিক আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থীরা রাত-দিন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তৃণমূলের কর্মীদের নিয়ে চেষ্টা করছেন নির্বাচনের মাঠ গোছানোর।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া)
বিএনপির প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুর রহমানের (পটল) মেয়ে ফারজানা শারমিন (পুতুল) আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে দলের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন ফজলুর রহমানের ছেলে ইয়াসির আরশাদ (রাজন), বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম (টিপু) ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিয়া আশরাফি (পাপিয়া)। ইতিমধ্যে তাইফুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে করতে অনড় অবস্থানে আছেন। তিনি নির্বাচনী ইশতেহার ছাপিয়ে ভোটারদের মধ্যে বিলি করছেন।
তাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আশা করছি, শেষ মুহূর্তে হলেও দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। আর যদি মনোনয়ন না-ও দেয়, তাহলে এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবই। সে লক্ষ্যে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছি। ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।’
তবে বিএনপির দলীয় প্রার্থী ফারজানা শারমিনের ভাষ্য, ‘টিপু ভাই একজন কেন্দ্রীয় নেতা, তিনি নিশ্চয় দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়াবেন। মনোনয়ন পাওয়ার পর আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি।’
আসনটিতে জামায়াতের লালপুর উপজেলার আমির আবুল কালাম আজাদকে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে। দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের আবদুল্লাহীল বাকি, বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদের মেহেদী হাসান (সোহাগ), খেলাফত মজলিসের আজাবুল হক, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির মোকাররেবুর রহমান (নাসিম) ও গণতন্ত্র মঞ্চের আনছার আলী (দুলাল) দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন।
অবশ্য ভোটার ও দলীয় নেতা–কর্মীরা বলছেন, এ আসনে ফলাফল নির্ভর করতে পারে বাগাতিপাড়া উপজেলার ভোটারদের ওপর। আলোচিত প্রার্থীরা লালপুর উপজেলার। তাঁরা বাগাতিপাড়া থেকে কে কতটা ভোট টানতে পারবেন, তার ওপর হার-জিত নির্ভর করবে।
নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা)
এ আসনে এবারও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার (দুলু) দলীয় প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় একবার তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছিলেন। এখানে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ দলীয় নেতা–কর্মীরা। তাঁর পক্ষে বিভিন্ন গ্রামে কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবেও কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ভোটাররা আগের চেয়ে আরও বেশি ভোটে আমাকে বিজয়ী করবেন। আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য তাঁরা মুখিয়ে আছেন।’
জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মো. ইউনুস আলীকে নাটোর-১ আসনে প্রার্থী করেছে দলটি। ভোটে জেতার জন্য তিনি ও তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীরা সাংগঠনিকভাবে বেশ তৎপর।
জেলা জামায়াতের আমির মীর নূরুল ইসলামের মতে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী অনেক বেশি শক্তিশালী। ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে ভোটাররা ইউনুস আলীকে বিজয়ী করবেন।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মান্নাফ এবং ইসলামী আন্দোলনের জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রচারে নেমেছেন।
নাটোর-৩ (সিংড়া)
প্রথম দফায় আসনটি ফাঁকা রেখেছিল বিএনপি। পরে ৪ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সদস্য আনোয়ার হোসেনকে (আনু) দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের চাচাশ্বশুর হওয়ায় বিষয়টি এলাকায় আলোচিত হচ্ছে। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভও হয়েছে।
তবে সেই আলোচনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিএনপির প্রার্থী আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার বিষয়টি বাঁকা চোখে দেখছেন। কিন্তু তাঁরা দেখেন না যে আমি ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছি। তা ছাড়া পরিবারের সবাই যে একই দল করবেন, তা নয়।’
জেলা বিএনপির আরেক সদস্য দাউদার মাহমুদ এখনো মনোনয়নের আশা ছাড়েননি। তিনি বিপুলসংখ্যক কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাঁর প্রত্যাশা, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনোনয়ন সংশোধন করে তাঁকেই চূড়ান্ত প্রার্থী করবেন।
এখানে জামায়াতের প্রার্থী সাইদুর রহমান। তিনি জেলা জামায়াতের শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য। তাঁর সমর্থকদের ধারণা, বিএনপির বিভেদ আসনটিতে জামায়াতকে এগিয়ে রাখতে পারে। এ ছাড়া এনসিপির জেলা কমিটির সদস্যসচিব জার্জিস কাদির দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন।
নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর)
বিএনপি এখানে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্য থেকে প্রার্থী করেছে দলের জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আজিজকে। তিনি তাঁর সমর্থকদের নিয়ে প্রচারে নেমেছেন। এই প্রচারে এখনো দলের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সদস্য মোস্তফা কামাল ও তাঁর অনুসারীদের যুক্ত করতে পারেননি। মোস্তফা কামালের বাবা (প্রয়াত) মোজাম্মেল হক এ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না বলেই ধারণা নেতা–কর্মীদের।
আবদুল আজিজ বলেন, ‘মোস্তফা কামাল একজন উদীয়মান তরুণ রাজনীতিবিদ। দলীয় মনোনয়ন তিনি প্রত্যাশা করতেই পারেন। আমি দলীয় মনোনয়ন লাভের পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। আশা করছি, তিনি ধানের শীষের পক্ষে থাকবেন।’
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী আবদুল হাকিম। তিনি বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই তিনি দুই উপজেলায় প্রচার–প্রচারণার পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে নির্বাচনী কমিটি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই। দলের প্রতিটি পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দিন–রাত দাঁড়িপাল্লার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।’
এ ছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন দলটির জেলা সভাপতি জামিল আহমেদ।