অবাধে বালু তোলায় ভোগান্তি

শুষ্ক মৌসুমেও নদের আশপাশের বাড়িঘরে ফাটল। দিনরাত ‘বাংলা ড্রেজারের’ কান ফাটানো শব্দে অতিষ্ঠ এলাকার বাসিন্দারা।

ব্রহ্মপুত্র নদের জামালপুর সদর উপজেলার পুরোনো ফেরিঘাট থেকে পিয়ারপুর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় নির্বিচারে বালু তোলা হচ্ছে। এতে ওই এলাকার ঘরবাড়ি, বাজার, সেতু, মহাসড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলার কারণে নদের দুই পাড়ে বর্ষায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। শুষ্ক মৌসুমেও নান্দিনা পশ্চিম বাজার এলাকায় ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর ভাঙনে তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা, বসতঘর, ফসলি জমি নদের গর্ভে চলে যাচ্ছে। শহরের ছনকান্দা থেকে নান্দিনা বাজার পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবু অপরিকল্পিত বালু তোলা বন্ধে কারও কোনো উদ্যোগও নেই।

গত বছর জেলা প্রশাসন সদর উপজেলায় নদের ২৭২ একর এলাকা দুটি বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেয়। গত সোমবার (২৫ মার্চ) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ বয়ে গেছে। ছন্দকান্দা থেকে নান্দিনা বাজার পর্যন্ত নদটি ভাঙতে ভাঙতে মহাসড়কের একদম কাছে চলে এসেছে। কোথাও ভাঙন ২০০ থেকে ৩০০ মিটারের মধ্যে। নদে পানি না থাকায় ভাঙা পাড়গুলো ভেসে উঠেছে। নদে কোথাও ড্রেজার মেশিনে আবার কোথাও এক্সকাভেটর দিয়ে খুঁড়ে বালু তুলে নেওয়া হচ্ছে। তীব্র ভাঙন রোধে বর্ষার সময় নদে ফেলা জিও ব্যাগ (বালুর বস্তা) ভেসে উঠেছে।

 ব্রহ্মপুত্র নদ ঘেঁষে নান্দিনা বাজার গড়ে উঠেছে। নদের তীর ঘেঁষে মার্কেট। মার্কেটের পেছন দিয়ে বসতঘর রয়েছে। যার একটি আল আমিন নামের এক ব্যক্তির। তাঁর বসতঘরের মেঝে ও দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখা যায়, নদের মধ্যে ড্রেজার মেশিন লাগানো একটি নৌকা। সেখানে বালু উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তর্ক চলছে। স্থানীয় লোকজন পাড় থেকে বালু তুলতে শ্রমিকদের নিষেধ করছিলেন। এই নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছিল।

আল আমিনের মতো ওই এলাকায় মো. শাজাহান আলী, উমর আলী, আবদুর রশিদ, হানিফ উদ্দিন, আবদুস সোহরাব, আনোয়ারুল ইসলাম, মাজুম হোসেন, মো. শাহীন মিয়া ও কেনা মিয়ার বসতঘরের দেয়াল ও মেঝেতে ফাটল ধরেছে।

বালু তোলা বন্ধের দাবিতে ১০ মার্চ নান্দিনা পশ্চিম বাজার এলাকায় স্থানীয় লোকজন জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ঘর ও মেঝেতে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় ঘরবাড়ি ভেঙে পড়তে পারে। বালু তোলার প্রতিবাদ করায়, তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। বালু তোলার কারণে আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে।’

নান্দিনা পশ্চিম বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আবদুস সোহরাব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ড্রেজারের কান ফাটানো বিকট শব্দে ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাই এখন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। শব্দের কারণে ঘরে মধ্যে ১০ মিনিট বসে থাকা যায় না। শুধু তা-ই নয়; বালু তোলার কারণে পাকা ঘরবাড়িতে বিশাল ফাটল ধরেছে।’

শরিফপুর, নান্দিনা, নরুন্দি ও পিয়ারপুর বালুমহাল ইজারাদার মো. আলম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদ থেকে আমরা বালু তুলি না। স্থানীয় লোকজন বালু তোলেন। ইজারার শর্ত না মেনে যাঁরা বালু তোলেন, বিভিন্ন সময় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

ছনকান্দা মুক্তার মাঠের দক্ষিণ পাশে ছোট্ট একটি ঘর। সেখানে প্রায় ২০ বছর ধরে মধ্যবয়সী আনোয়ারা বেগম ও আক্কাস আলী দম্পতির বসবাস। আক্কাস আলী বলেন, তাঁর ঘর থেকে নদটি প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ছিল। কয়েক বছরের ব্যবধানে ভাঙন নদ ঘরের একদম কাছে চলে এসেছে। তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত, আগামী বর্ষায় ঘরটি আর ভাঙন থেকে রক্ষা করা যাবে না।

ছনকান্দা ও চরযথার্থপুর বালুমহাল ইজারাদার হাজি বাহার উদ্দিন বলেন, বালু তোলার কারণে নদে ভাঙন দেখা দেয় না। নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে কিছুটা ভাঙন দেখা দেয়। তারপরও যেখানে ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে, সেখান থেকে বালু তুলতে নিষেধ করা আছে।

জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান বলেন, অবৈধভাবে কেউ বালু তুললে তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। নদের তীরবর্তী এলাকায় অনেক মানুষের ফসলের জমি এবং বাড়িঘর রয়েছে। বালু তোলার কারণে সেগুলো যাতে ক্ষতি না হয়, এ বিষয়ে তাঁরা তৎপর আছেন।