‘এক বছরেও মাংস জোটে না কপালে’

কাঁধে বহন করে লাউ ও টমেটো জামালপুর শহরের বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জামালপুর শহরের বানিয়া বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

৭৫ বছর বয়সী মুসলিম উদ্দিনের বাড়ি জামালপুর শহরের গেইটপাড় এলাকায়। তাঁর থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। তিনি পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় রেললাইনের পাশে ছাপরা তুলে থাকেন। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। সন্তানেরাও যাঁর যাঁর মতো থাকেন আলাদা। প্রায় ২০ বছর আগে তাঁর শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইসিস) হয়।

বর্তমানে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। কোনো উপায় না পেয়ে রিকশার মতো একটি গাড়ি বানিয়ে সেটাতে চড়ে বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে জীবন চালান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন সংসার চালাতে পড়েছেন বিপাকে।

আজ শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে জামালপুর পৌর শহরের পূর্ব মুকুন্দবাড়ী এলাকায় কথা হয় মুসলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সারা দিন ঘুরে খুব কষ্টে ২৫০ ট্যাহার মতো ইনকাম হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, এই ট্যাহায় কিছুই হয় না। বাজারে ১০০ ট্যাহার ছোট মাছ কিনলে, বাকি ট্যাহায় আর বেশি কিছু কিনা যায় না। এক বছরেও মাংস জোটে না কপালে।’

মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘যেইভাবে দিন যাইতাছে, সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেহি না। পরিবার চালাইতে হিমশিম খাইতাছি। একদিন ঘর থেকে বের হবার না পাইলে, পরের দিন মুখে খাওন জুটে না। ভাইগো ভাই, গরিব মানুষ কষ্টে আছে।’

একসময় ভ্যানগাড়ি চালিয়ে পুরো সংসার চালাতেন মুসলিম উদ্দিন। হঠাৎ প্যারালাইসিস হয়ে যায় তাঁর। এর পর থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা শুরু করেন। ভিক্ষা করে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসারের ঘানি টানতে হয়। জন্মের পর থেকেই নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন তিনি।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মুসলিম উদ্দিন জানান, কোনো দিন ঠিকমতো ভিক্ষা না পেলে মুখে ডাল-ভাতও জোটে না। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেন না। ভ্যানগাড়িটিও অনেকটাই বিকল হয়ে যাচ্ছে। টাকার অভাবে গাড়িটিও মেরামত করতে পারছেন না। ভিক্ষা করে প্রতি মাসে গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করেন। পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সেই সঙ্গে কয়েক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তাই পরিবার চালাতে তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। পরিবার সদস্যদের মুখে একমুঠো ডাল-ভাত তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন ভোরবেলায় গাড়ি নিয়ে জামালপুর শহরের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়ান।

এদিকে আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কাঁধে সবজির খাঁচা নিয়ে জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক শহরের দিকে ছুটছেন বৃদ্ধ আবদুর রাজ্জাক। ছোট বয়স থেকেই তিনি কাঁধে সবজির খাঁচা বহন করে আসছেন। এ সবজি বিক্রির টাকায় চারজনের সংসার চলে। তাঁর দুই মেয়ে স্নাতকে পড়াশোনা করেন। একদিকে সংসারের খাবার জোগাতে হয়, অন্যদিকে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। দুটি একসঙ্গে চালাতে এখন তাঁর নাভিশ্বাস অবস্থা। আবদুর রাজ্জাক বলেন, চিন্তায় সারারাত ঘুম আসে না তাঁর। সবজি বিক্রি করে, খুব অল্প টাকা আয় হয়। এই টাকা নিয়ে বাজারে গেলেই, সব ফুরিয়ে যায়। চাল-ডালসহ সবকিছুর যে দাম এখন, সপ্তাহের সাত দিনই আলুভর্তা কিংবা ছোট মাছ বা অবিক্রীত সবজির তরকারি দিয়ে চারজনের খাবার জোগান দিতে হয়।

প্রায় ২০ বছর আগে তাঁর শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইসিস) হয়। বর্তমানে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। কোনো উপায় না পেয়ে রিকশার মতো একটি গাড়ি বানিয়ে সেটাতে চড়ে বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে জীবন চালান
ছবি: প্রথম আলো

আজ সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত জামালপুর শহরের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সয়াবিন ও শর্ষের তেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসারে অভাব লেগেই আছে। অনেকেই আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে আছেন।

পঞ্চাশোর্ধ্ব সোহরাব আলী জামালপুর শহরের ব্রহ্মপুত্র তীরঘেঁষা পুরোনো ফেরিঘাট এলাকায় পাটের শোলা ভ্যানগাড়িতে ওঠাচ্ছিলেন। এ সময় কথা হলে সোহরাব বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সেও কাজ করে খাই। এই বাজারে পুলাপানগরেই চলে না। আমগরে কেমনে দিবো। এই শোলা ভ্যানগাড়িতে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে বিক্রি করি, মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার ট্যাকা ইনকাম হয়। সেই ট্যাকায় বুড়াবুড়িকে চলতে হয়। তবে এহন আর পারছি না। বাজারে কইটা ট্যাকা নিয়ে গেলে, বড় মাছ আর মাংস দেখলে চোখে জল চলে আহে। এক মাসেও একটা বড় মাছ বা মাংস কিনে খেতে পারি না। ওই যে গরিব মানুষের ডাল, আলু আর ভাত। ধনী মানুষের কী অবস্থা, বলতে পারমু না। তয় এই বাজারে আমগরে মতো গরিব মানুষের অবস্থা খারাপ।’

শহরের ডাকপাড়া এলাকার ভ্যানগাড়িচালক আলী আজাদ বলেন, ‘গরিব হয়েই জন্ম হয়েছে। সারাটা জীবন শুধু কষ্টই করলাম। এই বয়সেও ভ্যানগাড়ির ভাড়ার জন্যে ছোটাছুটি করতে হয়। এহনকার সন্তানেরা মা–বাবাকে খাওয়াই না। গায়ে খেটে যা ইনকাম করি, সেই ট্যাহায় সংসার চালাই। ঠিকমতো এখন ভাড়াও পাওয়া যায় না। ভাড়া পাইলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ইনকাম হয়। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এই ট্যাহায় কোনো রকম চাল-ডাল কিনতেই শ্যাষ। বাজারে এক কেজি চাল ৬০ ট্যাহা, এক কেজি আটা ৭৫ ট্যাহা, আর এক জেজি বেগুন ৫০ ট্যাহা। গরিব মানুষগরে হইছে মরণ।’