নদী-গবেষকের সাক্ষাৎকার

রাজশাহীর শিব নদ বাঁচাতে বৈদ্যপুরের বাঁধটি অপসারণ করতে হবে

শিব রাজশাহীর একটি পুরোনো নদ। এর ধারেই পাল আমলের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আশির দশকেও এই নদে লঞ্চ চলাচল করেছে। পণ্য পরিবহনে এবং তীরের উর্বর পলিমাটি এ অঞ্চলের ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে দখলে-দূষণে নদের ধারাটি মৃতপ্রায়। এখন এই নদের প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই নদ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে রাজশাহীর নদী–গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর সঙ্গে।

প্রথম আলো:

শিব নদের উৎপত্তি কোথায়?

মাহবুব সিদ্দিকী: এর উৎপত্তি নওগাঁর মহাদেবপুর এলাকায়। শিব নদ আত্রাইয়ের একটি শাখা।

প্রথম আলো:

এই নদের নামকরণ কীভাবে হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন?

মাহবুব সিদ্দিকী: আমাদের অনেক নদ-নদীর নাম দেবদেবীর নাম থেকে হয়েছে। তাই হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবের নামানুসারে এই নদের নাম হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

প্রথম আলো:

শিব নদের দৈর্ঘ্য কতটুকু? কোন দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে?

মাহবুব সিদ্দিকী: শিব নদ ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর শেষাংশ বারনই ৫৫ কিলোমিটার হবে। নদের প্রবাহ তানোরের বিলকুমারী বিলের ভেতর দিয়ে কালিগঞ্জ অতিক্রম করে পবা থানার বাগধানীতে এসে জামদহ নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বারনই নাম ধারণ করেছে। বারনই রাজশাহীর প্রাচীন নদীবন্দর নওহাটা, মোহনগঞ্জ, তাহেরপুর হয়ে চলনবিলে প্রবেশ করে মূল আত্রাইয়ে পড়েছে।

প্রথম আলো:

এই এলাকার পণ্য পরিবহনে শিব নদের কেমন ভূমিকা ছিল?

মাহবুব সিদ্দিকী: আগে শিব নদে নিয়মিত লঞ্চ চলাচল করত। আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর লঞ্চে নিজেই গিয়েছি। ১৯৮২ সালেও রাজশাহীর পবার প্রাচীন নদীবন্দর নওহাটা থেকে প্রতিদিন শিব নদ হয়ে লঞ্চ চলাচল করত। তানোরের চৌবাড়িয়ায় ঠিকাদারির কাজে রড-সিমেন্ট নিয়ে যেতেন হেরিটেজ রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ সদস্য গাফ্‌ফার খান। তাঁর কাছ থেকেই আমি শুনেছি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছিল। তানোরে উৎপন্ন ফসল এই পথেই পরিবহন করা হতো। এই নদের ভাটির অংশ পান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এ পথেই পান নলডাঙ্গা হয়ে ট্রেনে করে ব্রিটিশ আমলে উত্তর প্রদেশে চলে যেত। সেখান থেকে রাজশাহীর পান ট্রেনে রংপুর-দিনাজপুরে যায়। এই নদের ভাটিতে রামরামা গ্রামে রাজা কংস নারায়ণের প্রাচীন দুর্গামন্দির ও রাজপ্রাসাদ ছিল।

প্রথম আলো:

শিব নদের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলো কিসে?

মাহবুব সিদ্দিকী: ষাটের দশকের শুরুতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় জনগণ মান্দা উপজেলার বৈদ্যপুরে একটি বাঁধ নির্মাণ করে নদের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এখন আর আত্রাইয়ে বন্যার প্রবণতা নেই। এখন শিব নদে শুধু বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়। মূল আত্রাই নদের পানি আসতে পারে না। নদীকে বাঁচানোর জন্য এই বাঁধ অপসারণ করা দরকার।

প্রথম আলো:

সাধারণত নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠতে দেখা যায়। এই নদীর ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঐতিহাসিক জায়গা গড়ে উঠেছিল কি না...

মাহবুব সিদ্দিকী: বাংলাদেশের প্রথিতযশা প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া রচিত গ্রন্থে উল্লেখিত পাল আমলের জনপদের কথা আছে। সেটা এই নদের ধারেই গড়ে উঠেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত বাগধানীতে নবাবি আমলের একটি মসজিদ আছে, এটি এই নদকেন্দ্রিক সভ্যতার একটি অংশ।