কেবল শিক্ষার্থীরাই আছেন, সুযোগ–সুবিধা নেই

নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গায় চলছে ভূমি উন্নয়নের কাজ। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নামে নেত্রকোনায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আগামী অক্টোবরে চার বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে কেবল শিক্ষার্থীই ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাচ্ছেন না। সংকট আর অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই শিক্ষাজীবন কাটাচ্ছেন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (এসই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখছেন, সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। পর্যাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, আবাসন, গবেষণাগার, ক্যানটিন, খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতিচর্চাসহ বিনোদনের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এসব কারণে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়া ৩২৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত ৯ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছেন।

২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নীতি পাস হয়। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর শহরের রাজুর বাজার এলাকায় টিটিসির একটি তিনতলা ভবনে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি ও পরের বছর থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি অনুষদের অধীন চারটি বিভাগের শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩১৫ জন। তাঁদের মধ্যে ছাত্র ১৮৫ জন। আর শিক্ষক মাত্র ১১ জন। তাঁরা সবাই প্রভাষক।

চার বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁদের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলছে। হয়তো আর বছরখানেকের মধ্যে অনার্স শেষ হবে। কিন্তু এত দিনেও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাদ পাননি। প্রভাষকদের কাছে পাঠ নিয়েই কাটিয়ে দিতে হচ্ছে অনার্সের শিক্ষাজীবন। অবশ্য করোনার সময় অনলাইনে মাঝেমধ্যে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঠ নিতেন শিক্ষার্থীরা। এখন সে ব্যবস্থাও বন্ধ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা কোষাধ্যক্ষ সুব্রত কুমার আদিত্য বলেন, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের গতি কিছুটা পিছিয়েছে। অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক পদে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রার্থী আবেদন করেননি।

প্রতিষ্ঠার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে একনেকে ২ হাজার ৬৩৭ কোটি ৪০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার রামপুর, সাহিলপুর, গোবিন্দপুর, কান্দুলিয়া ও রায়দুমরুহি মৌজায় ২৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৫০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নিচু ওই জায়গায় ৬৫ লাখ ঘন মিটার বালু ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুরুজ্জামান খানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আগামী বছরের ২৭ মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের গড় অগ্রগতি মাত্র ২২ শতাংশ। এ ছাড়া গত ১ জানুয়ারি ১১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন এবং ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আগামী জুনের মধ্যে দুটি ভবনের কাজ শেষ হওয়ার কথা আছে। একাডেমিক ভবনের কাজ পায় ই-ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড। আর প্রশাসনিক ভবনের কাজ পায় বিশ্বাস ট্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি মাত্র পাইলিংয়ের কাজ শুরু করেছে।

সদর উপজেলার রামপুর, সাহিলপুর, গোবিন্দপুর, কান্দুলিয়া ও রায়দুমরুহি মৌজায় প্রায় ৫০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য শহরের সাতপাই পূর্বধলা রোড ও নাগড়া এলাকায় দুটি ভবন ভাড়া নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে মাত্র ৪১ জন ছাত্রী ও ৪৬ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা আছে। বাকি শিক্ষার্থীরা মেসে থাকেন। সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় একটি মেসে ভাড়া থাকেন দ্বিতীয় বর্ষের দুজন শিক্ষার্থী। তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সাতপাই এলাকায় থাকতে হচ্ছে। অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখানে আসলে পড়াশোনার মতো কোনো পরিবেশই এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কিছুরই সুবিধা নেই। এর মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় কী!

করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ কিছুটা পিছিয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. আনিস মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি যোগদান করার পর বালুভরাটসহ দুটি ভবন নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান কিছু কাজ হবে।’ তিনি জানান, ১০ তলাবিশিষ্ট ছাত্র হোস্টেল, ছাত্রী হোস্টেল, টিএসসি, লাইব্রেরি, সীমানাপ্রাচীর, মেডিকেল ও ডে-কেয়ার, ডরমিটরি স্থাপনের দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে।

২০১৮ সালের ১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গত ১ আগস্ট তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পান কোষাধ্যক্ষ সুব্রত কুমার আদিত্য। সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম কবীর। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫৬ জন।

সাবেক উপাচার্য রফিক উল্লাহ খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টি গতিশীল করার জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব কাজ সময়মতো করা যায়নি। ইউজিসির নিয়ম মেনে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে।’