নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার ছোট যমুনা নদীর পাড় থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে সদর ইউনিয়নের তেজাপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার তেজাপাড়া এলাকায় ছোট যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও পাড় থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। এতে নদীতীরবর্তী ফসলি জমি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, বালু উত্তোলন করতে বাধা দেওয়ায় বালুমহালের ইজারাদার তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদা দাবির অভিযোগে মামলা করেছেন।

এর প্রতিবাদে ৮ নভেম্বর বদলগাছি উপজেলা পরিষদের সামনের সড়কে সদর ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। এ সময় তাঁরা বলেন, বদলগাছী বালুমহালে তেজাপাড়া মৌজায় বালু উত্তোলনের কোনো পয়েন্ট নেই। এরপরও ইজারাদারের লোকজন এক মাস ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি তুলে বিক্রি করছেন। অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় ইজারাদার এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন।

গত মঙ্গলবার সকালে তেজাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে ১৫-২০ মিটার ভেতরে গভীর গর্ত করে মাটি কাটা হয়েছে। সেখানে একটি খননযন্ত্র রয়েছে। মাটি কাটার স্থান থেকে দক্ষিণে কয়েক হাত দূরে বালু উত্তোলনের জন্য নদীতে শ্যালো মেশিন বসানো রয়েছে। নদী থেকে বালু ও মাটি পরিবহনের ট্রাক–ট্রলি চলাচলের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি স্থান কেটে রাস্তা করা হয়েছে।

স্থানীয় ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেজাপাড়া মৌজা থেকে আগে কখনো বালু উত্তোলন কিংবা নদীর চরের মাটি তোলা হয়নি। অথচ এক মাস ধরে ইজারাদারের লোকজন নদীর বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরি করে তেজাপাড়া গ্রামের পাশে নদীর বাঁধসংলগ্ন এলাকা থেকে মাটি ও বালু তুলে বিক্রি করছে। গভীর গর্ত করে নদীর চরের মাটি তোলায় নদীতীরবর্তী ফসলি জমি ও নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০-২৫টি ট্রাকে করে প্রতিদিন অন্তত ২০০ বার গ্রামের রাস্তা দিয়ে বালু ও মাটি পরিবহন করায় গ্রামের রাস্তাটি নষ্ট হয়ে গেছে।

তেজাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মজিদ বলেন, ১৯৯০ সালে তাঁর বাবা ও তিনি তেজাপাড়া মৌজায় নদীর বাঁধসংলগ্ন ১৬৮ শতক জমি ১০০ বছরের জন্য ইজারা নেন। ওই জমিতে সবজি চাষ করে তাঁদের সংসার চলে। এবার ওই জমিতে কলাগাছের বাগান করেছেন। এক মাস ধরে বালুমহাল ইজারাদার তপন কুমার মণ্ডলের ব্যবসায়িক অংশীদার ভগীরথ কুমার ও আবদুস সালামের লোকজন তাঁদের জমির পাশ থেকে গর্ত করে মাটি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। যেভাবে গর্ত করে মাটি কাটা হয়েছে, তাতে তাঁদের ফসলি জমি আগামী বর্ষাতে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। এই জমি হারালে তাঁরা কী করে খাবেন?

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, বালুমহালের বাইরের এলাকা থেকে বালু তোলায় আর মাটি খনন করায় এলাকার মানুষ একত্র হয়ে গত সোমবার তাঁদের বাধা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সোমবার সন্ধ্যায় তপন কুমার মণ্ডল বদলগাছী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনিছুর রহমানসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। রাতেই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বাবুল আক্তার (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে থানা–পুলিশ।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগীরথ কুমার মণ্ডল বলেন, তপন কুমার মণ্ডলের প্রতিষ্ঠান মেসার্স স্বরূপ এন্টারপ্রাইজের নামে তিনিসহ ১০ জন বদলগাছী বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন। বদলগাছীর এনায়েতপুর থেকে জাবারীপুর পর্যন্ত ১১টি পয়েন্ট তাঁদের ইজারা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তেজাপাড়া পয়েন্টও রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তেজাপাড়া মৌজা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন শুরুর পর থেকেই বাধা দিয়ে আসছেন। সোমবার তাঁর বালু ও মাটি পরিবহনকারী ট্রাক আটকে দেন এবং চাঁদা দাবি করেন। বিষয়টি থানা–পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাক ছাড়িয়ে নেয়। রাতে ইজারাদার তপন বাদী হয়ে থানায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

ইউপি সদস্য আনিছুর রহমান বলেন, সোমবার তেজাপাড়া, জিধিরপুর ও চাংলা গ্রামের কয়েক শ মানুষ একত্র হয়ে বালু ও মাটি তোলায় বাধা দেন। এটা নিয়ে এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি জানার পর তিনি গ্রাম পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। এলাকাবাসী ও ইজারাদারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মীমাংসার জন্য মঙ্গলবার সকালে তেজাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে শোনেন, রাতে ইজারাদার তাঁকেসহ এলাকার কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দিয়েছেন। মামলার পর পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, বদলগাছির তেজাপাড়া এলাকায় নদী থেকে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলনের অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিয়া খাতুনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।