‘অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর সবকিছুই আছে, শুধু আমার জন্য বাংলাদেশে কষ্ট করে বেঁচে ছিলেন’

ম্যালকম আরনল্ড ও হালিমা বেগম

সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন ম্যালকম আরনল্ড। বাগেরহাটের বাসিন্দা হালিমা বেগমকে ভালোবেসে বিয়ে করে থিতু হয়েছিলেন খুলনায়। ২০০৪ সাল থেকে নগরের সোনাডাঙ্গার নিউমার্কেটের পেছনের মাদ্রাসা ক্রস রোড এলাকার ভাড়া বাসায় ছিল তাঁদের বসবাস। সেখানেই গতকাল বুধবার সকালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ম্যালকম। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে অথই সাগরে পড়েছেন হালিমা।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ভাড়া বাড়িতে গিয়ে হালিমাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি টিসিবির মালামাল নিতে বের হয়েছেন। হালিমা বেগম বলেন, ‘আর্থিক অনটনের কারণে যে বাসায় ভাড়া থাকি, সেই বাসার মালিক স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি টিসিবির কার্ড করে দিয়েছিলেন। মানুষটা মারা গেছেন, কিন্তু আমাকে তো বেঁচে থাকতে হবে। তাই টিসিবির মাল তুলতে যাচ্ছি।’

ম্যালকমের প্রসঙ্গ আসতেই হালিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মানুষটা এত ভালো ছিলেন যে তাঁর মতো কোনো লোক হয় না। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর সবকিছুই আছে, কিন্তু শুধু আমার জন্য সব ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে কষ্ট করে বেঁচে ছিলেন। আমার মা নেই, বাবা নেই, ভাইবোন—কেউ নেই। লোকটা আমার মাথার ওপর বটগাছের মতো ছিলেন। এখন আমি বড় একা হয়ে গেছি। পৃথিবীতে আমার আর কেউ থাকল না।’

স্বামীর মৃত্যুর পরদিন টিসিবির লাইনে হালিমা বেগম। আজ বৃহস্পতিবার সকালে খুলনা নগরের বয়রা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল সকাল সাতটার দিকে বাসাতেই মারা যান ম্যালকম আরনল্ড (৭৭)। তবে লাশ দাফন করতে বেজে গেছে প্রায় রাত আটটা। অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ম্যালকমের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে খুলনা নগরের বসুপাড়া কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে। লাশ দাফন করতেও বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে হালিমা বেগমকে। তাঁর ওই কাজে সোনাডাঙ্গা থানা-পুলিশ ও প্রতিবেশীরা সহযোগিতা করেছেন।

ম্যালকম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এক সচ্ছল পরিবারের সন্তান। আর হালিমা বেগম বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার পেড়িখালী গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ম্যালকম-হালিমার সংসারে কোনো সন্তান নেই। সংসারে আয়ের উৎস বলতে ছিল ম্যালকমের আঁকা ছবি বিক্রির টাকা।

ম্যালকমের সঙ্গে প্রথম দেখা, চিঠিতে দুজনের যোগাযোগ, ভালোবেসে বিয়ে—এসব স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে হালিমার মনে। দীর্ঘশ্বাস আর কান্না চাপা রেখে সেসব দিনের গল্প বলেই যেন কিছুটা স্বস্তি পেলেন হালিমা।

আরও পড়ুন

ম্যালকম আরনল্ড ২০০১ সালে আটজনের সরকারি এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। একটি বইয়ের কাজের জন্য সঙ্গীদের নিয়ে ম্যালকম যান সুন্দরবন দেখতে। ফেরার পথে মোংলার কাছে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে যান। আশপাশের খবর নিতে নিতে সেখানেই কিছুক্ষণের আলাপ হয় হালিমার সঙ্গে। দুজনই লিখে রাখলেন চিঠি পাঠানোর ঠিকানা।

অসহায় মানুষের জন্য রংতুলি ধরতে ভালোবাসতেন ম্যালকম

হালিমা তখন বেসরকারি এক উন্নয়ন সংস্থার মাঠকর্মী। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া হালিমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। তবে খুলনা শহরে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় নিজের আগ্রহে টেলিভিশন, রেডিও শুনে শুনে একটু-আধটু ইংরেজি শিখেছিলেন। ইংরেজি লিখতে বা পড়তে না পারলেও বলতে ও বুঝতে পারেন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া হালিমা।

ম্যালকম অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার পর ২০০৪ সালে গুরুতর অসুখ ধরা পড়ে হালিমার। চিকিৎসকেরা তাঁকে বাঁচানোর আশা প্রায় ছেড়ে দিলেও মেয়ে ফাতেমার জন্য হলেও বেঁচে থাকতে চাইলেন হালিমা। তখন মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে ঠিকানা লিখে রাখা কাগজটার কথা। উত্তর আসবে না ধরে নিয়েই হালিমা চিঠি পাঠালেন ম্যালকমকে।

আরও পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ায় তখন নাতাশা আর নেটি নামের দুই কন্যা বাবা ম্যালকমের সঙ্গেই থাকে। তবে তাদের মায়ের সঙ্গে ম্যালকমের বিচ্ছেদ হয় আরও ১৪ বছর আগে। হালিমার চিঠি পেয়ে মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশে ছুটে এলেন বন্ধুর চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসা চলাকালেই বন্ধুত্ব থেকে তাঁদের সম্পর্ক হলো প্রণয়ের। হালিমার চিকিৎসা শেষে ম্যালকম আবার চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু হালিমার জন্যই আবার ফিরেছেন বাংলাদেশে। ভালোবাসার টানে ম্যালকম ২০ বছর ধরেই থেকে গেছেন বাংলাদেশে।

ম্যালকম বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন আনাচকানাচের ছবি এঁকে পাঠিয়ে দিতেন বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে। সেখান থেকে ছবি বিক্রির টাকা আসত, তা দিয়েই তাঁদের সংসার ভালোই চলে যেত। বিপত্তি বাধে ২০২০ সালে কোভিডের সময়। লকডাউন আর আতঙ্কে একে একে বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায় ম্যালকমের। চিন্তায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ম্যালকম। প্যারালাইসিস হয়ে প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে বাঁ পাশ। বন্ধ হয়ে যায় ছবি আঁকা। এরপর বিভিন্ন মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলছিল হালিমাদের সংসার।

এখন কীভাবে সংসার চলবে, জানেন না হালিমা বেগম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কীভাবে ঘরভাড়া দেব, তা-ও জানি না। বাইরে হয়তো কোনো কাজ শুরু করতে হবে। করোনার সময় ম্যালকম অসুস্থ হয়ে পড়লে অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁর বড় ভাই গ্র্যান্ড আরনল্ড চিকিৎসার খরচ বাবদ ৩০০ ডলার করে পাঠাতেন। এখন হয়তো তা আর পাওয়া যাবে না।’