তদন্তে উঠে এল চসিক ও সিডিএর সমন্বয়হীনতা

গত ২৪ এপ্রিল হিজড়াখালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরাছবি: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সৌজন্যে

চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলায় হিজড়া খালে পড়ে ছয় মাসের শিশু সেহরিশের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটি। এসব কারণের বেশির ভাগই অব্যবস্থাপনা, গাফিলতি ও বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার ফল বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে এই মৃত্যুর দায় রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। সময়মতো পদক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকলে এই মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।

গত ১৮ এপ্রিল রাতে কাপাসগোলায় নবাব হোটেল–সংলগ্ন রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের হিজড়া খালে পড়ে যায়। রিকশায় ছিল ছয় মাস বয়সী সেহরিশ, তার মা ও দাদি। মা ও দাদি রক্ষা পেলেও খালের স্রোতে তলিয়ে যায় সেহরিশ। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে চাক্তাই খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, দুর্ঘটনাস্থলে খালের পাশে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল না। আগে বাঁশের ঘের ছিল, কিন্তু সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য সেটি ১০ এপ্রিল সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর আর নতুন করে কোনো বেষ্টনী দেওয়া হয়নি, এমনকি চসিককেও তা জানানো হয়নি। কাজ শেষে খালটির গভীরতা বেড়ে গেলেও কোনো সতর্কতার চিহ্নও রাখা হয়নি।

কমিটির সদস্যদের মতে, খালসংলগ্ন সড়কটি সরু ও ঢালু। বৃষ্টি হলে সড়কটি খালের সমতলে চলে আসে। দুর্ঘটনার দিনও তেমনটি ঘটেছিল। সড়কটির পাশেই রয়েছে ঘন আবাসিক এলাকা, কিন্তু এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও সেখানে আলো ছিল না, ছিল না কোনো সতর্কবার্তা বা রেলিং। রাতে ওই এলাকায় চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তা বোঝার সুযোগ ছিল না।

আরও পড়ুন

সমন্বয়হীনতা ও দায় এড়ানোর প্রবণতা

তদন্তে দেখা গেছে, যেদিকে শিশুটিকে নিয়ে রিকশাটি যাচ্ছিল, সেদিকে কাজ শুরুই করেনি সিডিএ। তবু তারা আগেভাগেই নিরাপত্তাবেষ্টনী সরিয়ে নেয়। তবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ঘাটতি নেই। আমরা কাজ শুরু করলে যেখানে দরকার, সেখানে স্থায়ী বেষ্টনী দিই।’

অন্যদিকে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। হিজড়া খালের পাশের সড়কটি চসিক নির্মাণ করেছে কি না, তা তাঁর জানা নেই।

তদন্ত কমিটির সদস্যদের মতে, এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি বা ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ ছিল না। সড়ক ও খালের মধ্যবর্তী অংশে রেলিং না থাকা, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকা এবং দুর্ঘটনার সময় সেখানে কোনো উদ্ধারকর্মী না থাকাও দায়ের মধ্যে পড়ে।

একের পর এক মৃত্যু, দায় কার?

সেহরিশের মতো এমন দুর্ঘটনায় গত ছয় বছরে চট্টগ্রাম নগরের খাল ও নালায় পড়ে অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৫ সালে ২ জন, ২০২৪ সালে ৩, ২০২৩ সালে ৩, ২০২১ সালে ৫ এবং ২০২০ সালে ২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সর্বশেষ ৯ জুলাই হালিশহরের আনন্দপুর এলাকায় তিন বছর বয়সী হুমায়রার মৃত্যু হয় মায়ের কর্মস্থলের পাশের নালায় পড়ে।

এত মৃত্যুর পরও এর আগে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি সিডিএ বা চসিক। সেহরিশের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর চসিক ২২ এপ্রিল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

এই কমিটিতে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েটের শিক্ষক, স্থপতি, নগর–পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা দেওয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ, প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত। মেয়র শাহাদাত হোসেন কানাডা থেকে ফিরলে তা জমা দেওয়া হবে।

তদন্ত কমিটির দুই সদস্য প্রথম আলোকে জানান, অন্তত নয়টি কারণ তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। এসবের মধ্যে আছে সড়কটি ঢালু ও সংকীর্ণ, নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকা, রাস্তার পাশে কোনো সতর্কতামূলক চিহ্ন না থাকা, পর্যাপ্ত আলো না থাকা, খালের অতিরিক্ত গভীরতা, অটোরিকশাচালকের অদক্ষতা, অতিবৃষ্টিতে খালের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, স্থানীয়দের সচেতনতার অভাব এবং জরুরি উদ্ধারসেবার ঘাটতি।

কমিটির সদস্যরা আরও বলেন, উদ্ধারকাজে সময় লেগেছে দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা। প্রশিক্ষিত ডুবুরি, উপযুক্ত সরঞ্জাম ও প্রস্তুতির অভাবে এমন ঘটনা আরও প্রাণহানি ঘটাতে পারে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ও চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সেখানে কারণ ও সুপারিশ দুটিই থাকবে। কোন সংস্থা কী দায়িত্ব পালন করবে, সেটিও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হবে।

আরও পড়ুন