অবৈধভাবে বালু তুলে বেড়িবাঁধ সংস্কার, ঝুঁকিতে সুন্দরবন
পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শাকবাড়িয়া নদীতে কয়েকটি খননযন্ত্র দিয়ে দিনরাত অবৈধভাবে বালু তুলছে একটি চক্র। নদীর সুন্দরবনের পাশ থেকে বালু তুলে অপর প্রান্তে কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার সেই বালু বস্তায় ভরে ভাঙন ঠেকাতে নদীতীরে ফেলছেন শ্রমিকেরা। অব্যাহতভাবে বালু তোলায় একদিকে বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের বনের অংশ, অন্যদিকে ঝুঁকিতে পড়ছে নির্মাণাধীন বাঁধ। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বারবার বাধা দিয়েও বালু উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা যাবে না। এ ছাড়া বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিক্রির জন্য খননের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হলেও বালু তোলা যাবে না। আইন অমান্যকারী দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
গত ২৭ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, শাকবাড়িয়া নদীর পূর্ব পাশে সুন্দরবন ও পশ্চিমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ। বন বিভাগের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ি-সংলগ্ন এলাকা থেকে সুন্দরবনের খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ির মধ্যবর্তী শাকবাড়িয়া নদীর ছয় কিলোমিটার এলাকার মধ্যে পাঁচটি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বালু তোলায় ইতিমধ্যে সুন্দরবনের গাছগাছালি ভেঙে নদীতে পড়তে শুরু করেছে। কয়েকটি স্থানে ভাঙনের পরিধি বেড়েছে।
কয়রার কাটকাটা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর অন্য প্রান্তে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে দুটি খননযন্ত্র চলছে। সেখান থেকে বার্জে করে বালু নদীর কিনারে এনে বস্তায় ভরছেন শ্রমিকেরা। বস্তা গণনা শেষে সেখানেই ফেলা হচ্ছে। কাজ তদারকির জন্য পাউবোর কোনো কর্মকর্তাকেও দেখা যায়নি। শ্রমিকেরা জানালেন, কয়েক দিন ধরে দিনের বেলায় বালু তোলা হচ্ছে। আগে রাতের বেলা সুন্দরবনের খাসিটানা এলাকার নদী থেকে বালু তোলা হতো। প্রতিদিন ১৫–২০ হাজার ঘনফুট বালু তুলে নদীর কিনারে এনে বস্তায় ভরা হয়। সুন্দরবনের পাশে যে খননযন্ত্র চলছে, সেটার মালিকের নাম হারুন গাজী।
পাউবোর কর্মী, শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাউবোর বাঁধ পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়রার দুটি পোল্ডারে ৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এ কাজে বালু সরবরাহ করছেন স্থানীয় খননযন্ত্রের মালিক হারুন গাজীসহ কয়েকজন। সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদী থেকে বালু উত্তোলনের বৈধ অনুমতি না থাকলেও দেদার বালু উত্তোলন ও বিক্রি করা হচ্ছে।
সুন্দরবন–সংলগ্ন কাটকাটা গ্রামের বাসিন্দা রিপন হোসেন বলেন, প্রতিদিন সুন্দরবন ও নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে বালু তোলায় ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে। অথচ বন বিভাগ কিংবা উপজেলা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দুই মাস আগে একবার খননযন্ত্রের মালিক হারুন গাজীসহ কয়েকজনকে জরিমানা করেছিল প্রশাসন। এর দুই দিন পর আবার বালু তোলা শুরু হয়। দিনের চেয়ে রাতের বেলা বেশি বালু তোলা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী উত্তর বেদকাশি এলাকার আসাদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের নদী থেকে অবৈধ বালু তোলার পেছনে একটি শক্তিশালী চক্র আছে। পাউবোর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই চক্রের সঙ্গে চুক্তি করে বালু তুলছে। নদীর যেখানে ভাঙনের তীব্রতা বেশি, সেখান থেকেই বালু তুলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে।
খননযন্ত্রের মালিক হারুন গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে পাউবোর বাঁধ মেরামত কাজের ঠিকাদার খলিলুর রহমান সেখান থেকে বালু তুলতে বলেছে। আমি প্রথমে রাজি না হওয়ায় ইউএনওর (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) একটি লিখিত অনুমতির কাগজ দেখিয়েছে।’
জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ দেখাশোনা করি। কয়রার ইউএনও শাকবাড়িয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে কি না, নিরীক্ষা করতে ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদারকি কমিটি করেছেন। সেই কাগজে সুন্দরবনের নদীর নাম দেখে, আমি ভেবেছি বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমার ভুল হয়েছে। আমি এখনই বালু উত্তোলন বন্ধ করে দিচ্ছি।’
সুন্দরবনের যে এলাকা থেকে বালু তোলা হচ্ছে, সেটি বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন। সেখানকার বন কর্মকর্তা সাদিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের পাশের নদী থেকে বালু তোলা বনের জন্য হুমকি। বিষয়টি জানতে পেরে আগেও কয়েকবার খননযন্ত্রের মালিকদের নিষেধ করা হয়। তবে তাঁরা প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তিনি কয়রার ইউএনওকে মৌখিকভাবে এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। দ্রুত লিখিতভাবে সংরক্ষিত বন ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কার বিষয়টি জানানো হবে।
কয়রার ইউএনও রুলী বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, শাকবাড়িয়া নদী থেকে কাউকে বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি যেসব জায়গায় বালু আছে, সেখান থেকে বালু তোলা যাবে কি না, দেখার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছেন। ওই কমিটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখবে। পরে তাঁদের লিখিত মতামত তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবেন। তারপর বালু তোলার বিষয়টি সিদ্ধান্ত হবে। এমনিতেই এলাকাটি নদীভাঙন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তিনি আগেও এলাকার বালুদস্যুদের জরিমানা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।