ইলিশ কি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নোয়াখালী থেকে

নদীতে ইলিশ না পাওয়ায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো চলছে না। সম্প্রতি নোয়াখালীর হাতিয়ার চেয়ারম্যানঘাট থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উপকূলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ার খবর আসছে। এমনকি ফেনী নদীতেও বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। তবে ইলিশের জন্য খ্যাত নোয়াখালীর মেঘনা নদীতে চলছে আকাল।

প্রতি মৌসুমে ইলিশের বেচাকেনায় জমজমাট থাকলেও জেলার হাতিয়ার চেয়ারম্যানঘাট বাজার এখন অনেকটাই ফাঁকা। নেই ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম। খালি জাল নিয়ে ফিরে আসা জেলেদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। নোয়াখালী থেকে ইলিশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তাঁদের।

ইলিশের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয় নোয়াখালীর হাতিয়ার মেঘনা নদীকে। এখানকার ইলিশ স্বাদে অনন্য বলে সারা দেশেই এর চাহিদা রয়েছে। মূলত মেঘনার ইলিশই নোয়াখালীর ইলিশ হিসেবে পরিচিত। তবে চলতি মৌসুমে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মেঘনা নদীতে রীতিমতো ইলিশের খরা চলছে।

দ্বীপের প্রধান ইলিশের বাজার চেয়ারম্যানঘাটে এখন যেসব ইলিশ বিক্রি হচ্ছে, তা মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। তা–ও পরিমাণে খুবই কম। এ কারণে এখানকার মাছের গদিগুলোর বেশির ভাগই ফাঁকা পড়ে আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের মেঘনা মোহনার তলদেশে পলি জমে নতুন ডুবোচর জেগে ওঠায় নদী নাব্যতা ও গভীরতা কমে গেছে। এ কারণে সাগর থেকে ইলিশ আসতে পারছে না।

জেলার মৎস্য বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর ২৪ হাজার ২৪৭ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছে নোয়াখালী উপকূলে। তবে চলতি বছর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আগস্টে জেলেরা তেমন মাছই পাননি। এ কারণে ইলিশ ধরা পড়ার হিসাবও নেই মৎস্য বিভাগের কাছে।

স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতিয়ার বেশির ভাগ মানুষের প্রধান পেশা মাছ শিকার। উপজেলার ছোট-বড় ৪১টি ঘাট থেকে মাছ শিকারে যান প্রায় অর্ধ লাখ জেলে। গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরা শুরু করেছেন জেলেরা। এরই মধ্যে আগামী অক্টোবরে ইলিশের প্রজনন সময়ের জন্য আসছে আরও ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা।

বর্তমানে ইলিশের ভরা মৌসুম চললেও জালে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা না পড়ায় লোকসানে রয়েছেন তাঁরা। জেলেরা যা মাছ পাচ্ছেন, এর মধ্যে জাটকার সংখ্যাই বেশি। এতে এ বছর যে সময়টুকু আছে, তাতে আর তেমন মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।

ভরা মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ায় শুধু জেলেরা নন, ব্যবসায়ীরাও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানান চেয়ারম্যানঘাটের শরীফ ফিশ আড়তের মালিক আবুল কালাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেসব নৌকার জেলেরা নদীতে ইলিশ ধরতেন, তাঁদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না। তবে যাঁরা গভীর সমুদ্রে যাচ্ছেন, তাঁরা কিছু মাছ পাচ্ছেন। তবে নদীতে প্রচুর পরিমাণ পোয়া মাছ ধরা পড়ছে। এতে মিটবে না ইলিশের ক্ষতি। অনেকে ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলেছেন।

গত বছরও মেঘনা নদীতে জাল ফেলে জেলেরা অনেক মাছ পেয়েছেন, যাতে খরচ পুষিয়ে লাভও হয়েছে। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিদিনই ইলিশ ছাড়া খালি হাতে ফিরছেন। কেন এমন হচ্ছে, জানতে চাইলে স্থানীয় জেলে আলাউদ্দিন বলেন, নদীর এ অংশে অনেক ডুবোচর জেগেছে। এতে ছোট নৌকা নিয়ে গভীর পানিতে গিয়ে মাছ শিকার করা সম্ভব হয় না। কারণ, ইলিশ গভীর জলের মাছ ডুবোচরের কারণে এখন মাছ এসব নদীতে আসে না।

হাতিয়ার পশ্চিম পাশে মৌলভীর চর থেকে নিঝুম দ্বীপের চর ফকিরা পর্যন্ত প্রায় ১০টি ডুবোচর রয়েছে বলে জানান বয়ারচরের জেলে সুমন মাঝি। তিনি বলেন, মেঘনার বিশাল এলাকায় মাছ শিকার করা যায় না। জাল ফেললে তা ডুবোচরের মধ্যে আটকে যায়। মাছ শিকার করতে হলে জেলেদের হাতিয়া থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে যেতে হয়। কিন্তু ছোট মাছ ধরা ট্রলারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এখানে নদী সব সময় উত্তাল থাকে।

হাতিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রাশেদ উদ্দিন বলেন, এ বছর ছোট-বড় সব ফিশিং ট্রলার আশানুরূপ মাছ পায়নি। হাতিয়ায় গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকারের মতো তিন শতাধিক ট্রলার রয়েছে। এসব ট্রলারে প্রায় ছয় হাজার জেলে রয়েছে। ডুবোচরের কারণে এই ট্রলারগুলোকে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার করতে হয়। এতে জ্বালানিসহ বিভিন্ন খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মেঘনায় ইলিশ না পাওয়া যাওয়ার অন্যতম কারণ ঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়া। কিছুদিন বৃষ্টি হলেও টানা বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার বঙ্গোপসাগরের মেঘনা মোহনায় পলি জমে অনেক ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। এতে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। নদীর পানিতে দূষণও বাড়ছে। এসব কারণে এবার মেঘনায় ইলিশ কম পাচ্ছেন জেলেরা।