বোর্ডের সদস্য না হয়েও নিয়োগ পরীক্ষার ‘পাহারাদার’ সংসদ সদস্য
ঠাকুরগাঁওয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে সশরীর উপস্থিত থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠেছে। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নীতিমালা অনুযায়ী তিনি নিয়োগ বোর্ডের সদস্য নন।
মাউশির নিয়ম না থাকলেও প্রভাবশালী হওয়ায় তা মানতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে সংসদ সদস্যের দাবি, যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নিতে নিয়োগ পরীক্ষায় পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী, ল্যাব সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাপ্রহরী ও আয়া পদের নিয়োগ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। মাউশির নীতিমালা অনুযায়ী এসব পদের নিয়োগ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য, মাউশি মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন।
আজ রোববার দুপুরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি সহকারী প্রধান শিক্ষক, দুটি করে অফিস সহকারী, আয়া, নিরাপত্তাপ্রহরী ও একটি ল্যাব সহকারী পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে এসব পদের বিপরীতে পরীক্ষা দেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। ঠাকুরগাঁও–১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনকে নিয়োগ বোর্ডে সশরীর উপস্থিত থেকে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে।
বেলা ১২টার দিকে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, অধ্যক্ষের কার্যালয়ে উপজেলার সারালী উচ্চবিদ্যালয়, পলাশ বাংলা উচ্চবিদ্যালয় ও কচুবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের জন্য মৌখিক পরীক্ষা চলছে। সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন করছেন। পাশে বসে আছেন কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল জলিল, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহানা খান ও সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমান। এ প্রতিবেদককে দেখে কক্ষের দরজা আগলে ধরেন এক ব্যক্তি।
পলাশ বাংলা উচ্চবিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নুর জামাল ও প্রধান শিক্ষক রাম কুমার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সরেজমিনে কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী অভিযোগ করেন, নিয়োগ বোর্ডের সদস্য না হয়েও সংসদ সদস্য বোর্ডের সদস্যদের বসিয়ে রেখে নিজেই নিয়োগ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। নিয়োগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন।
অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে তাঁকে অনেক অনিয়মের কথা শুনতে হয়। এ জন্য যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘নিয়োগ পরীক্ষায় আমি একপ্রকার পাহারাদার বলতে পারেন। আমি আমার সংসদীয় আসনের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ বোর্ডে গিয়ে যোগ্য প্রার্থী বেছে নেওয়ার অধিকার রাখি। সমালোচনা যতই হোক, আমি সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের মত নিয়ে যোগ্যদের বেছে নিতে সহায়তা করছি। সেখানে আমি কিছুই করি না, শুধু পাহারা দিই।’
সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমান বলেন, তিনি কয়েক দিন আগে এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। যোগদানের পর থেকে দেখছেন, এভাবেই নিয়োগ চলছে। সংসদ সদস্য এলাকার অভিভাবক। তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় থাকতে চাইলে তাঁরা কীভাবে নিষেধ করবেন?
মাউশির রংপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বোর্ড গঠনে অধিদপ্তরের নীতিমালা আছে। নিয়মানুযায়ী বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য, মাউশির মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা থাকবেন। এর বাইরে ষষ্ঠ কারও থাকার বিধান নেই। সংসদ সদস্য সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি নিজের মতো করে সেখানে (বোর্ডে) থাকছেন। যদিও নীতিমালায় এমন কোনো নিয়ম নেই।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না।’
এদিকে গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে সদর উপজেলার কচুবাড়ি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের তিনটি, শিকদারহাট উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি ও ভুল্লি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে তিনটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনকে সশরীর উপস্থিত থেকে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে।