পৌর ভবনে বসা সালিসে হত্যা মামলা আপসরফা হলো ১১ লাখ টাকায়

হত্যা
প্রতীকী ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় গৃহবধূ সোমা আক্তার (২৭) হত্যা মামলা সালিস বসিয়ে ১১ লাখ টাকায় আপসরফার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সালিসে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এর মধ্যে নিহত গৃহবধূর দুই সন্তান পাবে চার লাখ ও গৃহবধূর বাবা পাবেন সাত লাখ টাকা।

পৌরসভার মেয়রের ভাই, সাবেক ও বর্তমান কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগ নেতারা এই রফা করেন। গত রোববার বিকেলে আখাউড়া পৌরসভা ভবনের তৃতীয় তলায় বিষয়টি আপসরফা হয়। সালিসে হত্যা মামলা মীমাংসা নিয়ে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা।

নিহত সোমা আক্তার আখাউড়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চন্দনসার এলাকার জাকির হোসেনের স্ত্রী। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা–কাটাকাটির জেরে দুই মাস আগে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর পাঁচ বছরের একটি মেয়ে ও দুই বছরের একটি ছেলেসন্তান রয়েছে।

মামলার এজাহার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ জুন সকালে কথা–কাটাকাটির জেরে চন্দনসার এলাকার গৃহবধূ সোমা আক্তারকে বেধড়ক মারধর করেন প্রতিবেশী আরিফ হাসান ও তাঁর পরিবারের লোকজন। ২৩ জুন বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সোমার বাবা সেলিম মিয়া বাদী হয়ে আরিফ হাসানসহ তাঁর পরিবারের চারজনকে আসামি করে আখাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশ আরিফ হাসানের মা হোসনে আরা বেগমকে (৫৫) গ্রেপ্তার করে। বাকি আসামিরা এখনো পলাতক।

দানিস খলিফা সালিস সভায় সভাপতিত্ব করেন। সোমা হত্যার বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে। সোমার পরিবারকে ১১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুই লাখ টাকা আসামিপক্ষ দিয়েছে। এটি আমাদের কাছে জমা আছে। সব টাকা পাওয়ার পর সোমার পরিবারকে দেওয়া হবে।
শিপন হায়দার, কাউন্সিলর, আখাউড়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড

নিহত সোমার পরিবার ও সালিসে উপস্থিত লোকজন সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার বিকেলে আখাউড়া পৌর ভবনের তৃতীয় তলায় সাবেক ও বর্তমান কাউন্সিলররা সোমা হত্যা মামলার ঘটনাটি আপসরফার জন্য বসেন। আখাউড়া পৌর মেয়র তাকজীল খলিফার বড় ভাই ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি দানিস খলিফার সভাপতিত্বে সভা সঞ্চালনা করেন পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিপন হায়দার। বিকেল চারটায় শুরু হওয়া সভা শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্যানেল মেয়র এনামুল আহসান, বাবুল মিয়া, পৌর কাউন্সিলর জান্নাত হোসেন, সাবেক কাউন্সিলর আতিকুর রহমান, কাজী লিটন খাদেম, রফিকুল ইসলাম, মো. তাজুল ইসলাম, ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাদির মোল্লা, ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মানিক মিয়া। সভা শেষে ১৬ জনের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ড সোমার পরিবারকে ১১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। আসামিপক্ষ তাৎক্ষণিক দুই লাখ টাকা সালিস বোর্ডে জমা দেয়।

মামলার আসামি আরিফ আমার আপন ভাই আওয়াল মিয়ার ছেলে। সালিস নিয়ে আমাদের কোনা আপত্তি নেই।
মো. শাহজাহান মিয়া, নিহত সোমার শ্বশুর

সালিস সভায় থাকা এক সালিসকারক জানান, সালিসে নিহত সোমার পরিবারকে ১১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোমার দুই সন্তানকে চার লাখ টাকা ও গৃহবধূর বাবাকে সাত লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আখাউড়া পৌর মেয়রের বড় ভাই ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি দানিস খলিফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গৃহবধূর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তারা মামলাটি শেষ পর্যন্ত চালাতে পারবে না। দুই পক্ষ মিলে বিষয়টি মীমাংসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু কাজ থাকায় চলে আসি। কাউন্সিলররা ছিলেন, তাঁরা মীমাংসা করেছেন। আর আমি সালিসে সভাপতিত্ব করিনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে দানিস খলিফা বলেন, ‘বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে। তবে কত টাকায় মীমাংসা হয়েছে জানি না।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিপন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দানিস খলিফা সালিস সভায় সভাপতিত্ব করেন। সোমা হত্যার বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে। সোমার পরিবারকে ১১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুই লাখ টাকা আসামিপক্ষ দিয়েছে। এটি আমাদের কাছে জমা আছে। সব টাকা পাওয়ার পর সোমার পরিবারকে দেওয়া হবে।’

নিহত সোমার শ্বশুর মো. শাহজাহান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সালিসে ছিলাম। তবে জাকির (সোমার স্বামী) সালিসে উপস্থিত ছিল না। সালিসে ১১ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ টাকা দুই নাতির জন্য এবং সাত লাখ টাকা সোমার বাবাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সালিসে দুই লাখ টাকা দিয়েছে আসামিপক্ষ। টাকা কমিশনার (কাউন্সিলর) শিপন হায়দারের কাছে আছে।’ তিনি বলেন, ‘মামলার আসামি আরিফ আমার আপন ভাই আওয়াল মিয়ার ছেলে। সালিস নিয়ে আমাদের কোনা আপত্তি নেই।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের আইনজীবী নাসির মিয়া বলেন, হত্যা মামলা আপস কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা আপস করা যায় না। তাহলে সমাজে আইন ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না।

আখাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুল ইসলাম জানান, ‘হত্যা মামলা সামাজিকভাবে মীমাংসা করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকিরা পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এখন বাইরে কে কী করল, এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।’