মাঠজুড়ে ডালায় সাজানো ছোট-বড় রুপালি মাছ

বিক্রির জন্য ডালায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরে
ছবি: প্রথম আলো

একই গন্তব্যের দিকে ছুটছেন অনেক মানুষ। যেখানে বসেছে বিশাল সব মাছ নিয়ে মেলা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বিভিন্ন জাতের মাছ। মাঠজুড়ে ডালায় সাজানো ছোট-বড় রুপালি মাছ, যা দেখতে মানুষের ঢল নেমেছে। পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে আজ শনিবার দিনব্যাপী মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর এলাকায় মেলা চলবে।

এ মেলা উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই বাহারি মাছ বেচাকেনা শুরু হয়েছে। বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। শতবর্ষী এই মাছের মেলা এখন এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। আজ রাত পর্যন্ত চলবে বেচাকেনা। মেলায় ঘুরতে আসা মো. আমির বলেন, মেলায় অনেক বড় বড় মাছ উঠেছে। সাধারণত নিয়মিত হাটবাজারে এত বড় মাছ দেখা যায় না। প্রচুর মানুষও মেলায় এসেছেন।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শত বছর আগে এই মাছের মেলা শুরু হয়েছিল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনু নদতীরবর্তী মনুমুখে। পরে মনু নদের ভাঙনে মনুমুখ বাজারের আকার ছোট হয়ে আসায় মেলা স্থানান্তর করা হয় খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুর এলাকায়। এরপর প্রায় অর্ধশত বছর ধরে শেরপুরেই এই মাছের মেলা বসছে। পৌষসংক্রান্তির এক দিন আগে বসে এই মেলা। মৌসুমের সবচেয়ে বড় মাছগুলো মেলায় ওঠানো হয়। মেলার আড়ত থেকে খুচরা বিক্রেতারা মাছ কিনে ছড়িয়ে পড়েন মৌলভীবাজার জেলা সদরসহ বিভিন্ন ছোট-বড় হাটবাজারে। ২০০ থেকে ৩০০ খুচরা মাছ ব্যবসায়ী মেলায় ডালা সাজিয়ে বসেছেন। মেলা ঘিরে বছরজুড়েই প্রস্তুতি থাকে মৎস্যজীবীদের। তাঁরা মাছের ভালো দাম পেতে ও উৎসবের জন্য বিভিন্ন বিল-বাঁওড়ে মাছ পুষে বড় করেন। মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাওয়াদীঘি, হাইল হাওর, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওর, মনু, কুশিয়ারাসহ ছোট–বড় নদ-নদী থেকে ধরা মাছ এই মেলায় নিয়ে আসা হয়। করোনা বিধিনিষেধে দুই বছর মেলা হয়নি।

ঐতিহ্যবাহী এই মাছের মেলায় এবারও বৃহত্তর সিলেটের হাওর, বিল, বাঁওড় ছাড়াও যশোরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মাছ এসেছে। মাছ এসেছে যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর।
ডালায় বাহারি মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরে
ছবি: প্রথম আলো

আজ স্থানীয় বাসিন্দা ও কবি ইয়াসিন সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা দুই বছর বন্ধ থাকলেও মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহের একটুও ভাটা পড়েনি। সিলেট বিভাগের নানা প্রান্ত থেকে মাছ কিনতে ও দেখতে এবারও মানুষ এসেছেন। কয়েক বছর ধরে প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যক্তিদের চেষ্টায় মেলায় অশ্লীল নৃত্য, জুয়ার আসর ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড অনেকটাই বন্ধ আছে। এটা আশাব্যঞ্জক। তিনি আরও বলেন, মেলাটি আগে কুশিয়ারা নদীর তীরে বসলেও সেখানে জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। মেলাটি স্থানসংকটে কয়েক বছর ধরে শেরপুরের পশ্চিমে বেড়ি বিলের পাশে ধানের জমিতে হচ্ছে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলার স্থায়ী জায়গা দরকার। সেই সঙ্গে মেলায় গ্রামীণ সংস্কৃতির উপস্থিতি ক্রমে কমে আসছে। গ্রামবাংলার আদি সংস্কৃতি, যেমন বাউল গান, বায়োস্কোপ, গ্রামীণ ও লোকজ পণ্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে মেলাটি আরও প্রাণবন্ত হতো।

মেলায় আসা দর্শনার্থী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ঐতিহ্যবাহী এই মাছের মেলায় এবারও বৃহত্তর সিলেটের হাওর, বিল, বাঁওড় ছাড়াও যশোরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মাছ এসেছে। মাছ এসেছে যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর।

মাছের মেলার অন্যতম আয়োজক আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা অন্যান্যবারের মতোই হয়েছে। দুই বছর মেলা হয়নি। তাই অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন। এবার আবার মেলায় প্রাণ ফিরেছে।
যমুনা নদীর বড় আকারের পাঙাশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ নিয়ে এসেছেন নজমুল মিয়া নামের একজন। তিনি পাঙাশ মাছের দাম হাঁকছেন ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। বোয়াল, আইড়, চিতল, রুই, কাতলা এ রকম ১০-২০ কেজি ওজনের মাছের তো ছড়াছড়ি। একটি বাঘাড়ের দাম হাঁকা হয়েছে দেড় লাখ টাকা, যার ওজন প্রায় ৭৫ কেজি।

গতকাল বিকেল থেকেই মেলায় মানুষ আসতে শুরু করেন। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে মেলার মাঠ। গতকাল সকাল থেকে মেলায় পুরোদমে বেচাকেনা চলছে। মাছের পাশাপাশি মেলায় উঠেছে শিশুর খেলনা, সংসারের তৈজস, দা, খুন্তি, কাঠের আসবাব, প্রসাধনসামগ্রী, কৃষিপণ্য, কৃষি যন্ত্রপাতি, সবজি-আনাজ, তিলুয়া-বাতাসা, খইলসহ নানা খাদ্যসামগ্রী, যা ঐতিহ্যবাহী শেরপুরের মাছের মেলাকে প্রাণ দিয়েছে।

মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে ডালায়। শুক্রবার বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরে
ছবি: প্রথম আলো

শেরপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অলিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর পুরোপুরি বন্ধ ছিল মেলা। প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ছিল মেলা। মাছের মেলায় আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। ২০টি মাছের আড়তে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে।

আজ শেরপুরের শ্রীহট্ট সাহিত্য সংসদের সভাপতি নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এটি ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। অতীতকাল থেকে মাছের সঙ্গে লোকজ পণ্য ও সংস্কৃতির মেলা বসেছে এখানে। আগামী বছর থেকে ঐতিহ্যের ধারাটির ওপরই জোর দেওয়া হবে। এখানে এসে মানুষ যেন নিরাপদ ও স্বস্তির সঙ্গে লোকজ আনন্দ পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হবে।