কয়রায় বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চলছে ঘের ব্যবসা

বাঁধ কেটে অথবা ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে নদীর পানি ঘেরে তুলে চলেছেন ঘেরমালিকেরা। খুলনার কয়রায়
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে ও পাইপ ঢুকিয়ে লবণ পানি উঠিয়ে চলছে ঘের ব্যবসা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলের বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নোনা পানির বিরূপ প্রভাবে উজাড় হচ্ছে বনজ ও ফলদ সম্পদ। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার ১৩/১৪-১ ও ১৩/১৪-২ এই দুই পোল্ডারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধে চার শতাধিক স্থানে বাঁধের নিচে পাইপ ঢুকিয়ে বা ছিদ্র করা হয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার লোকা, মঠবাড়ি, দশালিয়া, শিকারিবাড়ি ক্লোজার, নয়ানি স্লুইসগেটসংলগ্ন এলাকা, কাটকাটা, গাজীপাড়া, ৬ নম্বর কয়রা, গোবরা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মদিনবাদ লঞ্চঘাট, জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালি এলাকার ঘেরমালিকেরা বাঁধ কেটে অথবা ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে নদীর পানি ঘেরে তুলে চলেছেন। এতে এসব এলাকার প্রায় ২১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিষয়টি স্বীকার করে কয়রা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক বলেন, ‘উপজেলায় এখন ৬ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে নোনা পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এর অধিকাংশ ঘেরেই লবণ পানি তুলে সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। আমরা চাষিদের উৎসাহিত করছি সেমিইনটেনসিভ বা আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে।’

পাউবোর বেড়িবাঁধে চার শতাধিক স্থানে বাঁধের নিচে পাইপ ঢুকিয়ে বা ছিদ্র করা হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ২১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, এসব স্থান দিয়ে সারা বছরই অবাধে নদী থেকে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এলাকার জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা চিংড়ি চাষের সঙ্গে জড়িত বলে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। তাঁরা আরও বলেন, ২০২২ সালের প্রথম দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাঁধে বসানো অবৈধ পাইপ অপসারণের কাজে নেমেছিল পাউবো। এ জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল চিংড়িচাষিদের। কাজের কাজ কিছু হয়নি। ঘেরমালিকেরা নির্বিঘ্নে তাঁদের কাজ চালিয়ে আসছেন। পাউবো কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা বললেও তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

উপজেলার নদীভাঙনকবলিত গোবরা এলাকার কৃষক তৈয়েবুর রহমান ও মেসবাহউদ্দিন বলেন, নোনা পানির চিংড়ি চাষের প্রভাবে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। বাঁধ ভাঙনের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া পুকুরে মাছ নেই। হাজার হাজার ফলদ ও বনজ বৃক্ষ মরে যাচ্ছে। গ্রামে হাঁস-মুরগি প্রায় বিলুপ্ত হচ্ছে। আর সবজির খেত তো চোখেই পড়ে না। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও মিষ্টি পানির মৎস্যসম্পদ এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। পরিবেশও হুমকির মুখে পড়েছে।

নোনা পানির চিংড়ি চাষের প্রভাবে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। বাঁধ ভাঙনের শিকার হচ্ছে। খুলনার কয়রায়
ছবি: প্রথম আলো

কয়রার পাথরখালী গ্রামের অঞ্জলি মুন্ডা ও ৬ নম্বর কয়রা এলাকার আশিকুজ্জামাম বলেন, নোনা পানির চিংড়ি চাষের প্রভাবে প্রতিবছর নদীর বাঁধ ভাঙছে। এ ছাড়া এলাকার বিলে-খালে দরিদ্র মানুষগুলোর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে নোনা পানির চিংড়িচাষিরা ছোট নদী-খালগুলো অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছেন। ফলে দরিদ্র মানুষ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হয়ে কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন।

কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলাম বলেন, কয়রার বিভিন্ন পোল্ডারে বেড়িবাঁধ কাটার ফলে তা এখন দুর্বল ও হুমকির মুখে পড়ছে। দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান থাকছে না। পরিবেশ রক্ষায় অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ কেটে নোনা পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ হওয়া দরকার। এ ছাড়া ওই সব চিংড়িচাষির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

কয়রা উপজেলাটি পড়েছে পাউবোর সাতক্ষীরা অঞ্চলের বিভাগ-২-এর আওতায়। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, যাঁরা অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে নোনা পানির চিংড়ি চাষ করছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাপ্তরিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। দ্রুত বেড়িবাঁধের অবৈধ পাইপ অপসারণ করা হবে।