মুক্তির যুদ্ধ—১
৫ দিনের ছাতক যুদ্ধ বেকায়দায় ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল মার্চে। এরপর ছোট–বড় অসংখ্য যুদ্ধে রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ডিসেম্বরে আসে বিজয়। প্রতিরোধের সেই লড়াই নিয়ে এ আয়োজন।
‘১৯৭১ সালে আমি বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আহত হয়েছিলাম একবার। তবে ছাতকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। মনে হয়েছিল, এই যুদ্ধেই হয়তো প্রাণ যাবে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।’ বলছিলেন সুনামগঞ্জের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান।
সুনামগঞ্জের ছাতক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে ছিল। সেটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে অক্টোবরে ছাতক অপারেশনের পরিকল্পনা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খণ্ড), প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড) বইয়ে।
সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে বইয়ে মো. ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক ‘অপারেশন ছাতক’ নামে একটি লেখা লিখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ছাতকের উত্তরে দোয়ারাবাজারের সীমান্তে বাঁশতলার অবস্থান। এটি ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা সাবসেক্টরের সদর দপ্তর। তাদের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। ছাতক অপারেশন চালাতে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্প থেকে বাঁশতলায় আসে। এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল।
পাঁচ দিনের এই যুদ্ধে ২৫ থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। ছাতক যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সে কথা স্বীকার করেন।
ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই পুরো এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। সঙ্গে ১২ আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স (একেএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) ও স্থানীয় রাজাকারদের দল।
সুনামগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী ছাতক যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর লেখা রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ বইয়ে তিনি এই যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ‘এ’ কোম্পানি বালিউড়া বাজারে অবস্থান নেয়। মেজর আকবরের ‘বি’ কোম্পানি জয়নগর টিলায় যায়। ‘সি’ কোম্পানির মেজর মহসিনকে দোয়ারাবাজারে এবং ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়ক লে. নুরুন্নবীকে ছাতক-সিলেট রোডের গোবিন্দগঞ্জে অবস্থান নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। লে. মনজুর ‘ই’ কোম্পানি নিয়ে কোম্পানীগঞ্জের বিপরীতে রাধানগরে অবস্থান নেন। এ ছাড়া সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন আকবরের কোম্পানিও ছিল।
শাফায়াত জামিল সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর বইয়ে নিজের যুদ্ধদিনের কথা লিখেছেন। সেখানে ছাতক যুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেছেন, ১৪ অক্টোবর সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দিনভর প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল এগিয়ে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাছাকাছি টিলার উঁচু স্থানগুলোতে অবস্থান নেয়।
পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে ছাতক শহরে চলে যায়। সন্ধ্যার মধ্যেই মুক্তিবাহিনী ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় ঢুকে পড়ে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের আরেকটি কোম্পানির সেনারা বিকেল থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে মুক্তিবাহিনীকে পেছন থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। অনেক রাত পর্যন্ত যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষে বলা হয়েছে, ৭০–৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আর শত্রুপক্ষের দুই শতাধিক নিহত হয়।
১৪ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ছাতক শহর থেকে এসে নুরুন্নবীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর কোম্পানির ওপর হামলা চালায়। তাঁরাও পাল্টা হামলা অব্যাহত রাখেন। সন্ধ্যার আগে পাকিস্তানিদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদী পার হয়ে পারকুল গ্রামে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। পাকিস্তানি বাহিনী পারকুল গ্রাম লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু আর্টিলারি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে।
পরের দিন ১৫ অক্টোবর সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তিনটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর মেশিনগানের গুলি চালায়। থেমে থেমে এই লড়াই চলে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত।
মো. ইদ্রিস আলীর মতে, পাঁচ দিনের এই যুদ্ধে ২৫ থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। তবে মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষে বলা হয়েছে, ৭০–৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আর শত্রুপক্ষের দুই শতাধিক নিহত হয়।
ছাতক যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সে কথা স্বীকার করেন।