এক বছরের ছোট্ট ওয়াজিদা আধো পায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঘরে এসে বাবার ছবিতে তাকিয়ে ‘বা-বা, বা-বা’ বলে ডাকছে। সে জানে না, তার বাবা আর কোনো দিন তার কাছে ফিরে আসবে না। মা বলে ডাকবে না। কোলে তুলে কপালে চুমু খাবে না।
একমাত্র সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে বাবা হুমায়ুন কবির রাশিয়ায় চড়া বেতনে চাকরি করার জন্য তিন মাস আগে বাড়ি ছাড়েন। সঙ্গে যান তাঁর ভগ্নিপতি রহমত আলী। দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছেও যান। কিন্তু এরপরই তাঁরা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েন। তাঁদের রুশ সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঠানো হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের ড্রোন হামলায় গত ২৩ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরের মৃত্যু হয়। রহমত আলীরও ডাক পড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তিনিও মৃত্যুঝুঁকিতে ভুগছেন।
হুমায়ুন কবির (২৮) নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রামের মৃত মহসিন আলীর ছেলে এবং রহমত আলী (৩০) নওগাঁর আত্রাই উপজেলার নন্দিগ্রামের পিয়ার আলী মণ্ডলের ছেলে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর ১৩ দিন পার হলেও হুমায়ুন কবিরের লাশের সন্ধান মেলেনি। বাঁচার আকুতি জানিয়েও দেশে ফিরতে পারছেন না রহমত আলী। বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের আশা করছেন স্বজনেরা।
হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী তারা খাতুন জানান, ড্রিম হোম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কোম্পানির মাধ্যমে ১৯ লাখ টাকার বিনিময়ে রাশিয়ায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি করার জন্য বাড়ি ছাড়েন তাঁর স্বামী ও ননদের স্বামী। গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে তাঁদের প্রথমে সৌদি আরবে নেওয়া হয়। সেখানে দুই মাস লুকিয়ে রাখার পর পাঠানো হয় রাশিয়ায়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োগ না করে রুশ সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁরা তাঁদের ২১ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করেন। গত ২৩ জানুয়ারি হুমায়ুন প্রতিপক্ষের ড্রোন হামলায় যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান। রহমত আলী কোনোমতে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। তাঁকে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছে।
তারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০ জানুয়ারি স্বামীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। তখন কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছেন, “আমরা তো যুদ্ধ করতে আসিনি। কিন্তু দালালেরা আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমরা হয়তো বাঁচতে পারব না।” তারা খাতুন বলেন, ‘মাত্র তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। একমাত্র মেয়েটাও ছোট। মেয়ের খরচের কথা চিন্তা করে জমি বন্ধক রেখে ও ধারদেনা করে দালালকে টাকা দিছিলাম। সব হারালাম। এখন অন্তত ওর লাশটা চাই।’
রহমত আলীর স্ত্রী যমুনা বেগম বলেন, সর্বশেষ গত পরশু (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে স্বামীর সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। তিনি নিজেও হুমায়ুনের লাশ দেখতে পাননি। ওই ঘটনার পর তিনি দেশে ফিরে আসতে সেনা কর্মকর্তাদের পায়ে ধরেছেন। কিন্তু তারা তাঁকে ছাড়েননি। আজ মঙ্গলবার তাঁকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর কথা। কিন্তু গতকাল সোমবার থেকে তাঁকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনিও একমাত্র সন্তান নাদিয়াকে (৩) নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
হুমায়ুনের মা করিমন বেওয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানের টুকরা দুটারে হারাইছি। শুনছি একজন মারা গেছে। অন্যজন মারা যাওয়ার পথে। আমি এখন শুধু ছেলের লাশ আর জীবিত জামাইকে ফেরত চাই। আর যাদের কারণে আজ এই অবস্থা হয়েছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।’