হাত ঘুরলেই বাড়ে দাম

কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা প্রতি কেজি বেগুন কিনছেন ৩ টাকায়।হাত ঘুরে সেই বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। 

তারাগঞ্জ উপজেলার তারাগঞ্জ হাটে চড়া দামে সবজি বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা
প্রথম আলো

কৃষক মিজানুর রহমান পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মুলা বিক্রি করে পেয়েছেন ৩ টাকা। মাত্র ১০০ গজ দূরে খুচরা বিক্রেতারা সেই মুলার দাম চাইছেন কমপক্ষে ১২ টাকা। সেই সবজি ঢাকায় গিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৭ টাকা।

সম্প্রতি রংপুরের তারাগঞ্জ হাটে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেল। উপজেলার হাটবাজারগুলোতে ভরা মৌসুমে চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও কৃষকদের তেমন লাভ থাকছে না। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। হাত ঘুরলেই বাড়ছে সবজির দাম। এতে ঠকছেন সাধারণ ক্রেতা ও কৃষকেরা।

মুলা বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না দাবি করে চিকলী গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘খুচরা বাজারে মুলা কিনবার গেইলে ১০-১২ টাকার নিচোত পাওয়া যাওছে না। এই মুলা আবার হামার ছাওয়ারা (ছেলেমেয়েরা) যারা ঢাকাত থাকে, তারা ১৭-১৮ টাকা কেজি দরে কিনি খাওছে। বাজারোত ফসলের দাম ঠিকই আছে। হামরা বেচপার গেইলে খালি দাম নাই। এত লোকসান হইলে কৃষক বাঁচপে কেমন করি।’

হাটে কথা হয় ভীমপুর গ্রামের কৃষক জয়নাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি দুই মণ বেগুন নিয়ে এসেছিলেন। পাইকারের কাছে ১২০ টাকা মণ দরে ২৪০ টাকায় বিক্রি করেছেন। জয়নাল আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাইকার আর দোকানি সউগ সময় ধান্দা করে কেমন করি কৃষকোক ঠকা যায়, দুইটা টাকা কম দেওয়া যায়। ওমরা এটা বোঝে না যে হামরা মাথার ঘাম পায়োত ফেলে রোইদোত পুড়ি পানিত ভিজি ফসল ফলাই।’

একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইকরচালী গ্রামের কৃষক আজারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হামার খালি খাটাখাটিই সার। যা লাভ পাইকারের আর দোকানির। হামারটে কিনোছে ৩ টাকাত আর ওমরা হামার মতোন মানুষেরটে বেচাওছে ১৫-২০ টাকাত। চোখের সামনোত এমনতো করি ঠকুছি। তা-ও কিছু কবার পাওছি না।’

হাট ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারেরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি মুলা ৩ টাকা, বেগুন ৩, বাঁধাকপি ১০, ফুলকপি ১২, পটোল ২৫, গাজর ৫০, শিম ৩৫, লাউ ৮, টমেটো ৬০ টাকা দরে কিনে নিচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতার কাছে পাইকারেরা প্রতি কেজি মুলা ৫, বেগুন ৪, বাঁধাকপি ১৫, ফুলকপি ১৭, পটোল ৩২, গাজর ৬০, শিম ৪০, লাউ ১০, টমেটো ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজার থেকে ১০০ গজ দূরে খুচরা বিক্রেতারা আবার প্রতি কেজি মুলা ১০, বেগুন ১০, বাঁধাকপি ২০, ফুলকপি ২৫, পটোল ৪০, গাজর ৭০, শিম ৫০, লাউ ২০, টমেটো ৯০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

তারাগঞ্জ খুচরা বাজারে সবজি কিনতে আসা দৌলতপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, এখন সবজির ভরা মৌসুম। তবু বাজারে সবজির দাম খুব চড়া। এক কেজি পটোল আর শিম কিনতে ১০০ টাকা চলে যায়। বাকি খরচ তো আছে। অথচ গত বছর এ সময় ১০০ টাকায় ব্যাগভর্তি সবজি নিয়ে বাড়িতে ফেরা যেত।

ওই বাজারের খুচরা কাঁচামাল বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, কৃষকেরা তাঁদের কাছে সরাসরি ফসল নিয়ে আসেন না। পাইকারেরা তাঁদের মালামাল সরবরাহ করেন। পাইকারি দরের চেয়ে দু-এক টাকা বেশি নিয়ে তাঁরা ক্রেতাদের কাছ মালামাল বিক্রি করছেন।

কাঁচামালে সব সময় ঘাটতি থাকে জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী বজলুর রশিদ বলেন, ‘আমরা যেসব সবজি দোকানে আনি, তা এক দিনে বিক্রি হয় না। প্রতিদিনই এসব সবজিতে ঘাটতি হয়। অনেক সময় পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই কেনা দামের থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে বিক্রি না করলে লোকসান হয়।’

তারাগঞ্জ সবজি হাটের পাইকার জোনাব আলী বলেন, ‘কৃষকেরা আমাদের কাছে সবজি নিয়ে আসেন। আমরা সব সময় ন্যায্য দাম দেওয়ার চেষ্টা করি। তারাগঞ্জ থেকে ঢাকার আড়তে এক কেজি বেগুন পাঠাতে খরচ পড়ে দেড় থেকে দুই টাকা। বেগুন কিনতে হয় চার টাকা। ঢাকার আড়তে বেগুন বিক্রি করি ১২-১৩ টাকা। ঘাটতি তো আছেই। সব বাদ দিয়ে আমাদের লাভ থাকে ২-৩ টাকার মতো।’

পানির দরে বেগুন বিক্রি

প্রতিনিধি, বদরগঞ্জ, রংপুর জানান, বদরগঞ্জে বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে ভোক্তাদের সেই বেগুন কিনতে হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫-২০ টাকায়।