পরজীবী কুমারীলতা ফুলের মুগ্ধতা

তালগাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে হাসছে কুমারীলতা
ছবি: প্রথম আলো

উত্তরের বাতাসে ঝোপের মধ্যে থোকা থোকা বুনো ফুল দোল খাচ্ছে। দেখতে অনেকটা কুলগাছের ফুলের মতো। বসন্তের দুপুরের কমলা রোদের সঙ্গে ফুলের দুলুনি ক্লান্ত পথচারীর নজর কেড়ে নেয়। কৌতূহল নিয়ে কাছে যেতেই ফুরফুরে বাতাসে ভেসে এল মিষ্টি ঘ্রাণ। পরজীবী এই উদ্ভিদ ঝোপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটি ছোট তালগাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে হাসছে। আরও কাছে গিয়ে দেখা গেল, কাঁটায় ডালপালার ভেতরে অনাদরে ফুটেছে সুগন্ধী এই ফুল। ফুলের গাছটি খুব পরিচিত। এর স্থানীয় নাম কুমারীলতা। লতানো এ গাছের শরীরজুড়ে কাঁটা। কিন্তু এর ফুলের রূপ-লাবণ্য-সুবাস অনন্য।

সম্প্রতি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা সদরের পূর্ব দিকে চর রাজাপুর এলাকায় জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনায় ঝোপের মধ্যে এই বুনো ফুলের দেখা পাওয়া গেল। একসময় দেশের প্রায় সব ঝোপঝাড়ে দেখা মিলত কুমারীলতার, বিশেষ করে নদীপাড়ের ঝোপজঙ্গলে কিংবা সড়কের পাশের বেড়ে ওঠা বুনো গাছগাছালির ভিড়ে। কিন্তু প্রতিনিয়ত উজাড়, দখল ও দূষণের কবলে বনের পরিধি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এখন প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় কুমারীলতার মতো বুনো গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না।

ফুলের রূপ-লাবণ্য দেখে ভাবাই যায় না কাঁটাযুক্ত এমন উদ্ভিদের ফুল এটা। লতানো গাছের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। যখন এসব গাছে ফুল ফোটে, তখন পুরো গাছ আলোয় অবগাহন করে। মোহন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে চারপাশ। কুমারীলতার ফুলও তেমন। থোকা থোকা ফুল এর দ্যুতি ছড়ায় বহুদূরে।

কুমারীলতা কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ হলেও এর নবীন পাতা ও কচি ডগার সৌন্দর্য আলাদা
ছবি: প্রথম আলো

কুমারীলতা শক্ত লতানো ও কাঁটাযুক্ত আরোহী উদ্ভিদ। পাতার অগ্রভাগ সরু, বৃন্তদেশ গোলাকার, পাতার ওপরের দিকটা মসৃণ। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল—এ সময়ে ফুল ফোটে। গাঢ় ঘিয়ে রঙা ফুল অনেকটা ছাতার মতো বিস্তৃত হয়ে শোভা ছড়ায়। ফুল থেকে আসে ছোট ছোট দানার ফল।

বহুবর্ষজীবী গুল্ম উদ্ভিদ কুমারীলতার উজ্জ্বল সবুজ প্রাপ্তবয়স্ক পাতাগুলোর পুরুত্ব একে প্রথমে চামড়াজাতীয় কিছু বলেই মনে হতে পারে। তবে এর নবীন পাতা ও কচি ডগার সৌন্দর্য আলাদা। নরম তুলতুলে। সাধারণত কুমারীলতা অন্য উদ্ভিদের ওপর এর কাঁটার আকর্ষীর সাহায্যে ভর করে বেড়ে ওঠে। কুমারীলতার পাতা ও শিকড়ের ঔষধি গুণাগুণের কথাও বেশ প্রচলিত আছে।

প্রজাপতির প্রজনন, বৃদ্ধি ও জীবন ধারণে সহায়ক এই বুনো কুমারীলতা। প্রজাপতি মূলত উদ্ভিদের পাতায় ডিম দেয় এবং সেখানেই ডিম ফুটে লার্ভায় পরিণত হয়। লার্ভাগুলো ওই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে। ‘লার্ভা’ থেকে ‘পিউপা’য় পরিণত হওয়ার পর পিউপাগুলো ওই গাছের পাতার সঙ্গে ঝুলে থাকে। এভাবেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়।

নিসর্গবিদদের মতে, কুমারীলতা বীজে বংশবৃদ্ধি হয়ে থাকে। সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের তোড়ে এখন লতা, গুল্ম, পশুপাখির প্রজাতির বিলুপ্তির বেড়ে গেছে চারদিকে। গ্রামগুলো শহর হচ্ছে, শহর হচ্ছে আরও বিরান। কিন্তু প্রকৃতির অতিপ্রয়োজনীয় এসব অনুষঙ্গ এখন অবহেলায় হারাতে বসেছে। কিন্তু এসব সংরক্ষণ না করলে মানুষ, প্রাণপ্রকৃতি বিপদাপন্ন হবে।