আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বাসদ, না ইসলামী আন্দোলন?

নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

নির্বাচন কমিশন আগামী মে বা জুনের মধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় মাঠপর্যায়ে এ নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তবে বিএনপি নির্বাচনে না এলে বরিশালে আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবে কোন দল, তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আলোচনা আছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বরিশালে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব ভোট ব্যাংক আছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতা মনীষা চক্রবর্তী শ্রমজীবীদের অধিকার আদায় ও নানা সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁরও আলাদা একটি ভোট ব্যাংক আছে বলে মনে করা হয়। বিএনপির বাইরে এই দুই দলের ভোট ব্যাংক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই এখন অস্বস্তির কারণ। ফলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে মনীষা ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০১৮ সালে বাসদ ও ইসলামী আন্দোলন মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছিল। গতবার ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ছিলেন ওবায়দুর রহমান। এবার অসুস্থতার কারণে তিনি আর প্রার্থী হচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রার্থী দেবে দলটি। আর বাসদের প্রার্থী ছিলেন মনীষা চক্রবর্তী। 

ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব ভোট ব্যাংক থাকার প্রমাণ মিলেছিল ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে। ওই বছর বরিশাল সদর আসনে (সিটি করপোরেশন এলাকা ও সদর উপজেলা) ২৭ হাজার ১৫৬ ভোট পায় ইসলামী আন্দোলন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককভাবে ১৬০টি আসনে অংশ নেয় ইসলামী আন্দোলন। ওই নির্বাচনে দলটি ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৪ ভোট পেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না—এমন অভিযোগ করে অংশ নেয়নি দলটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনেই প্রার্থী দিয়ে আলোচনায় আসে ধর্মভিত্তিক দলটি। ওই নির্বাচনে একটি আসনে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট গ্রহণের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগে একপর্যায়ে ফলাফল বর্জনের ঘোষণা দিলেও প্রায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোট পড়ে দলটির বাক্সে। অর্থাৎ, প্রায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৩ ভোট যায় তাদের ‘হাতপাখা’ প্রতীকে।

এরপর স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে এই দলের প্রার্থীরা ভালো ভোট পেয়েছেন। এতে ভোটের রাজনীতিতে দলটির গুরুত্ব বেড়েছে। ১৬ মার্চ পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও বরগুনার তালতলী উপজেলার একটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের হারিয়ে তিনজন চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে এই দলের। ফলে এখন দলটির নেতা-কর্মীদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। তাই ভোটের মাঠে বিএনপির অনুপস্থিতিতে বরিশাল সিটি নির্বাচনে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে দলটি।   

বরিশাল নগরের রাজনীতি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন, এমন তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিগত দিনের নির্বাচনগুলোতে মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন কখনো প্রার্থী দেয়নি। ফলে চরমোনাই পীরের অনুসারীদের অধিকাংশ ভোটই বিএনপির বাক্সে পড়েছে। কিন্তু গতবার দলটি মেয়র পদে প্রার্থী দেওয়ায় বিএনপির সেই ভোট পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়। এবারের নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি সমর্থনকারী ভোটারদের একটি বড় অংশের ভোট হাতপাখার বাক্সে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে দলটির প্রার্থী ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা-ভাবনা করলে অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নির্বাচনে কৌশলী হতে হবে।

এই তিন বিশিষ্ট ব্যক্তির মত, মনীষা চক্রবর্তী শহরের নাগরিক নানা সমস্যার সমাধানে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। বরিশাল নগরের অন্তত ১০ হাজার তিন চাকার যানের চলাচলের বৈধতা আদায়ের জন্য তিনি লড়ে যাচ্ছেন। এসব যানের চালকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে গত এক যুগে বড় একটি ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেশ। সব মিলিয়ে মনীষার ব্যক্তিগত ইমেজ আগামী নির্বাচনী মাঠে তাঁকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাবে।

ইসলামী আন্দোলনের নেতারা আপাতত স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে ভোটের রাজনীতিতে পাকাপাকি অবস্থান তৈরি করতে চাইছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি ভোটে না এলে অবশ্যই দলটির সৎ, আদর্শবান ভোটাররা আমাদের দিকে ঝুঁকবে। আগামী পাঁচটি সিটি নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় আছেন। চার সিটিতে আমরা প্রার্থী দিয়েছি। বরিশালে এখনো দিইনি। সেখানে শক্তিশালী প্রার্থী দেব আমরা।’ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায়, তাই তারা চায় সবকিছু নিজেদের দখলে রাখতে। এ জন্য সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে সন্দেহ আছে। তবে রংপুরের মতো প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা দিলে, ভোট চুরি না করলে ইসলামী আন্দোলন অনেকগুলো সিটিতে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় আছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সম্পাদক রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটের মাঠে বিএনপি না থাকায় যেখানেই মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই অঘটন ঘটছে। কলাপাড়া ও তালতলীতে তিনজন হাতপাখা প্রার্থীর (ইসলামী আন্দোলনের দলীয় প্রতীক) জয় তারই প্রতিফলন।’

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস আজ শনিবার সকালে এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোক বলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট সব সময় এক বাক্সে পড়ে, এটা সত্য। তবে বরিশাল সিটি নির্বাচনে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ, এখানে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ এবং বরিশাল নগরের মানুষও বেশ সচেতন। মানুষ বুঝে গেছে আওয়ামী লীগ মানেই মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন, উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে যা করেছেন, তা অভাবনীয়। তাই বরিশাল নগরের মানুষের এখন উন্নয়নের পক্ষে। আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মানুষ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকেই বিজয়ী করবে।