কিশোরগঞ্জের হাওর–অধ্যুষিত উপজেলা ইটনার বড়হাটি ইউনিয়নের শেখেরহাটি গ্রামের ১৬ বছর বয়সী সাকিব বাবা হারিয়েছে ৭ বছর আগে। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার যখন আর চলছিল না, তখন মা সায়েরা বেগম সাকিবকে ভর্তি করান ছনছাড়া এতিমখানায়। তিন বছর ধরে সাকিব বেড়ে উঠছে এই এতিমখানায়। এতিমখানাটির অবস্থান কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের ছনছাড়া গ্রামে।
আজ ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এতিমখানা থেকে পরিবেশিত সেমাই খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যায় সাকিব। ফিরে এসে কিছুক্ষণ নিজ কক্ষে, পরে অন্যদের সঙ্গে ফুটবল খেলে সময় পার করছিল। ওই সময় কথা হয় তার সঙ্গে।
কেমন কাটছে ঈদ—এমন প্রশ্নে সাকিব একটু আনমনা হয়ে পড়ে। উত্তর দিতে কিছুটা সময় নেয়। পরে এককথায় বলে, ‘আব্বা খুব আদর করত। নতুন জামা কিনে দিত। আব্বার লগে নামাজ পড়তাম। আব্বারে মনে পড়তেছে। সকালে একবার আম্মার লগে ফোনে কথা হইছে। আম্মারে দেখুম।’
একে একে কথা হয় এতিমখানার আরও ১২ শিশু-কিশোরের সঙ্গে, যাদের এবার ঈদ কাটছে ছনছাড়া এতিমখানায়।
রাব্বী (৯) ও লাদেন (৭) দুই ভাই। নামাজ শেষে অন্যদের সঙ্গে দুই সহোদর ফুটবল খেলছিল। তাদের বাড়ি ভৈরব উপজেলার শম্ভুপুর এলাকায়। পাঁচ মাস আগে তাদের বাবা মুছা মিয়া হয়ে মারা যান। এর পর থেকে দুজনের ঠিকানা এই এতিমখানায়। মা ও বাবার আদরের বাইরে প্রথম ঈদ এটি। দুজনই জানায়, মায়ের কাছে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। বাবার কথা মনে পড়ছে।
১০ বছর বয়সী মো. নীরব শোবার ঘরে বসে অনেকটা নীরবে সময় কাটাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করতেই নীরব বলে, ‘আম্মা কখন আইব?’ নীরবের বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর মরিচাকান্দি গ্রামে। জানাল, বাবা তাকে খুব আদর করত। ঈদে ঘুরতে নিয়ে যেত। নামাজ পড়তে যেত একসঙ্গে।
ছয় বছর বয়সী তাওশিফ খয়েরি রঙের একটি পাঞ্জাবি পরে পরিপাটি হয়ে মাঠে হাঁটছিল। তার বাবা আফছার উদ্দিন সেচ পাম্পে কাজ করতেন। মারা গেছেন দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে। সাতজনের সংসার টানতে গিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না মা আকলিমা বেগম। শেষে তাওশিফকে ছনছাড়া এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। নিজের ঘরের বাইরে এটি তাওশিফের প্রথম ঈদ। পাঞ্জাবি কে কিনে দিল—এমন প্রশ্নে তাওশিফ মাথা নিচু করে জানাল, এতিমখানা থেকে দেওয়া হয়েছে।
দুপুরে দিকে এতিমখানায় আসেন এনআরবিসি ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক রকিবুল হাসান। সঙ্গে ভৈরব শাখার আরও সাত কর্মকর্তা। উদ্দেশ্য এতিম শিশু-কিশোরদের হাতে ঈদের সালামি হিসেবে নতুন নোট তুলে দেওয়া। তাঁর নেতৃত্বে আগের ঈদেও নতুন নোট দেওয়া হয়েছে।
রকিবুল হাসান বলেন, ‘ছোটবেলার ঈদের সঙ্গে সালামি এখন স্মৃতি হয়ে আছে। আর সালামি যদি নতুন নোট হয়, তাহলে কথা নেই। আমার মনে হয়েছে, এতিম শিশু–কিশোরদের হয়তো ঈদের সালামি পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। মনের এই শূন্যতা পূরণে আমি দুই বছর ধরে এ কাজ করছি।’
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এতিমখানা সুপার পদে আছেন আবদুল্লাহ এরশাদ। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, ছনছাড়া এতিমখানার যাত্রা শুরু ১৯৫৮ সালে। বেসরকারি উদ্যোগে এতিমখানাটি পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান শিশু–কিশোর রয়েছে ৭০ জন। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত এতিমখানায় বিনা পয়সার থাকা, খাওয়া ও পড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সকালে সবার জন্য পিঠা ও সেমাই রান্না করা হয়।
রান্নাঘরে দুপুরের খাবার তৈরি করছিলেন বাবুর্চি মাজেদা বেগম। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নাকে পোলাও ও খাসির মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়। মাজেদা বেগম বলেন, ঈদে সব সময় বিশেষ খাবার রান্না হয়। আজও হচ্ছে। দুপুরে পোলাও, খাসির মাংস ও ঢ্যাঁড়সভাজি দিয়ে খাবে এতিমরা। রাতেও রান্না হবে ভালো খাবার।