সড়ক দুর্ঘটনায় পা, আগুনে প্রাণ হারানো কালিপদর পরিবার দিশাহারা

কালিপদ বিশ্বাসের বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি। আজ রোববার সকালে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মোবারকপুর গ্রামেছবি: সংগৃহীত

ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন কালিপদ বিশ্বাস (৪৫)। কয়েক বছর আগে যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পান। সেখানে পচন (গ্যাংগ্রিন) দেখা দেয়। পরে অস্ত্রোপচার করে ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। এরপর সংসার চালাতে অন্যের জমিতে টিনের ছাপরা তুলে মুদিদোকান দেন কালিপদ। গত শুক্রবার রাতে সেই দোকানে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। আগুন লেগে দোকানটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দগ্ধ হয়ে মারা যান কালিপদ বিশ্বাস।

কালিপদ বিশ্বাসের বাড়ি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মোবারকপুর গ্রামে। আগুন লাগার পর তাঁকে বাঁচাতে এসে দগ্ধ হয়েছে ছেলে অমিত বিশ্বাস। তাকে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালিপদর স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে। দুই শতক জমির ওপর মাটির দেয়ালের একটি ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই পরিবারটির। দোকানদারি করে তিনি মেয়ে রিপা বিশ্বাসকে যশোর সরকারি সিটি কলেজে অনার্সে ও ছেলে অমিত বিশ্বাসকে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ কালিপদর মৃত্যুতে পরিবারটি দিশাহারা হয়ে পড়েছে।

দুই শতক জমির ওপর মাটির দেয়ালের ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই পরিবারটির।
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার রাজগঞ্জ এলাকায় ঝাঁপা বাঁওড়ের ভাসমান সেতুর পূর্ব পাশে কালিপদ বিশ্বাসের দোকানটির অবস্থান। তাঁর ছোট ভাই পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, ২০১৭ সালে অন্যের জমিতে টিনের ছাপরা তুলে দোকান শুরু করেন কালিপদ। দোকানে তিনি মুদির মাল ও চা বিক্রি করতেন। রাতে নিয়মিত দোকানে ঘুমাতেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে স্ট্রোক করেন কালিপদ। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার দোকানে ফিরে যান।

পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, দোকানে আগুন জ্বলতে দেখে বাবাকে বাঁচাতে এসে দগ্ধ হয়েছে অমিত বিশ্বাস (১৭)। তাকে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থাও ভালো নয়। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বার্ন ইউনিটে নেওয়া জরুরি। কিন্তু চিকিৎসার খরচ দেওয়ার মতো কোনো টাকা পরিবারের হাতে নেই।

অগ্নিকাণ্ডের আগে শুক্রবার রাতে কালিপদ বিশ্বাসের সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেশী সঞ্জয় চৌধুরী। তিনি বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে কালিপদর দোকানে চা পান করে তাঁরা গ্রামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যান। কালিপদ বিশ্বাসও গিয়েছিলেন। রাত তিনটার দিকে তিনি দোকানে ফেরেন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে দোকানে আগুন জ্বলতে দেখে তাঁরা দৌড়ে এসে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) ফোন দেন। তারপর ফায়ার সার্ভিসের লোক আসেন।

প্রতিবেশীরা জানান, আগুনে স্বামীর মৃত্যু ও ছেলে দগ্ধ হওয়ার পর মলিনা বিশ্বাসের (৩৫) চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছেন। মাঝেমধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন, ‘আমরা এখন কী করে বাঁচব?’

কালিপদ বিশ্বাসের মেয়ে রিপা বিশ্বাস (২০) বলেন, ‘বাবার দোকানের আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলত। আমরা দুই ভাই-বোন লেখা করতাম। আমি বাড়ি থেকে গিয়ে কলেজে ক্লাস করি। ভাই যশোরে থাকে। বাবার ইচ্ছা ছিল আমার ভাই ইঞ্জিনিয়ার হবে। পরিবারে আর দুঃখকষ্ট থাকবে না। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। এখন কী করে আমরা লেখাপড়া করব, আর কী করেই–বা ভাইকে বাঁচাব?’

মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম মেহেদী মাসুদ বলেন, সম্ভবত কয়েলের আগুন থেকে দোকানে আগুন লেগেছে। এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।